-->
শিরোনাম

টেকসই উন্নয়নে আরো উন্নত করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষাকে

অঞ্জন দাশ
টেকসই উন্নয়নে আরো উন্নত করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষাকে

দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার লক্ষ্যে নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীদের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে মৌলিক শিক্ষার পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

 

দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি জাতীয় উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। আর কোনো জাতির উন্নত ও দক্ষ জনশক্তি বিনির্মাণ সে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। স্ব-স্ব দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতির মজবুত ভিত তৈরি করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্রগুলো পৌঁছে যাচ্ছে সফলতার চূড়ায়। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনকে কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়নে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, সেটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ ও উপবৃত্তি প্রদান, ক্লাসগুলোতে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, ডিজিটাল হাজিরাসহ স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হচ্ছে। ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধাদির লক্ষ্যে নতুন ভবন তৈরি করা এবং ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীর জন্য পৃথক মানসম্পন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা করার কার্যক্রমসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বাস্তবায়ন সারা দেশে চলমান।

 

জাতীয় উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও গতিশীল সমাজ গঠনে গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। আর এই সময়োপযোগী প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে একজন নিবেদিতপ্রাণ, যোগ্য, দক্ষ ও পেশাদারি মনোভাবাপন্ন স্মার্ট শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্তরেই ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, পরোপকারিতা ও ন্যায়পরায়ণতা শেখানো শিক্ষকের একান্ত দায়িত্ব।

 

শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা ও মানসিক বিকাশে গতানুগতিক শিক্ষাদানের বাইরে গিয়ে ছবি এঁকে, গান শুনিয়ে, গল্প বলে শিশুদের পাঠে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেজন্য সেসব বিষয়েও তাকে পারদর্শী হতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর মনমানসিকতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। সর্বোপরি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য-ঐতিহ্য, বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তির ব্যবহারে আগ্রহী এবং পারদর্শী করে তুলতে হবে।

 

শিশুদের বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে প্রথমে শিক্ষক, বাবা-মা এবং অন্য অভিভাবকদেরও স্মার্ট ও আধুনিক মনমানসিকতার মানুষ হয়ে উঠতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের মতো অভিভাবকদের ভূমিকাও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে মানসিক চাপ মুক্ত করতে সহায়তা করা অভিভাবকদের একান্ত দায়িত্ব। পরীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা হারাচ্ছে। এ ব্যাপারে অভিভাবক এবং সমাজকে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। অভিভাবকদের উচিত শিশুদের পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়া, বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।

 

এ ছাড়া যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রাথমিকের কার্যক্রম তদারকি এবং বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত, তাদের আন্তরিক ও স্বতঃস্ফূর্ত দায়িত্ব পালন ছাড়া মানসম্মত আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা অসম্ভব। বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন ক্লাস্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নিয়মিত পরিদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয় গুরুত্ব বিবেচনায় গৃহীত নানামুখী উদ্যোগ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

 

যেমন- শিক্ষার্থীদের পড়ার পরিবেশ উন্নত করার জন্য প্রতিটি ক্লাসরুমে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো, ফ্যান, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং বাইরে সুপেয় পানি, সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, ছেলে ও মেয়েশিশুদের জন্য পৃথক স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ‘স্মার্ট ওয়াশব্লক ’ নির্মাণ করতে হবে এবং তা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

শিশুদের নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা জরুরি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যথাসময়ে আগমন ও প্রস্থান নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল হাজিরা মেশিন স্থাপন করা এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া পূর্বে স্থাপিত মেশিনগুলো মেরামতক্রমে সচল রাখা যেতে পারে।

 

গতানুগতিক পড়ালেখা ও শুধুই ভালো ফল করার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতেই বই পড়ার অভ্যাস তৈরির লক্ষ্যে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘স্মার্ট পাঠাগার’ কিংবা অনলাইনে মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে ‘স্মার্ট প্রাইমারি মোবাইল লাইব্রেরি’ চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট জাতি বিনির্মাণে বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিক্ষার্থী তথা সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে ‘উপজেলা প্রশাসন পাবলিক লাইব্রেরি’ স্থাপন করা উচিত।

 

প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের লক্ষ্যে স্মার্ট বোর্ড, কম্পিউটার, প্রজেক্টর, মাল্টিমিডিয়া, সিসি ক্যামেরা, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা চেয়ার-টেবিল, শিক্ষক সব শিক্ষার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উঁচু মঞ্চ স্থাপন, পোডিয়াম এবং সাউন্ডবক্সের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’ তৈরি করা যেতে পারে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিশুদের ইতিহাস-ঐতিহ্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে স্মার্ট মিনি মিউজিয়াম এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে তৈরি করার লক্ষ্যে ‘স্মার্ট সায়েন্স জোন’ স্থাপন করা যেতে পারে।

 

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাব স্কাউটিং কার্যক্রম জোরদার এবং বিভিন্ন ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, আইসিটি ক্লাব স্থাপন করে শিশুদের আনন্দঘন পরিবেশে শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ ঘটানো সম্ভব। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বাউন্ডারি ওয়াল এবং দৃষ্টিনন্দন গেট থাকা খুবই জরুরি। এবং প্রতিদিন একজন করে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় গেটে দাঁড়িয়ে স্বাগতম জানানো এবং প্রথম কুশলাদি বিনিময় করা যেতে পারে।

 

এছাড়া শিশুদের সুন্দর মনের অধিকারী করে বড় করে তোলার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে ফুলের বাগান তৈরি এবং খেলাধুলা করার জন্য খেলার মাঠ ও মিনি পার্ক তৈরি করা যেতে পারে। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গাছের চারা বিতরণ, খেলাধুলার সামগ্রী, গরিব ও নিম্ন মধ্যবর্তী শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

মাঝে মাঝে অন্য যে কোনো সফল পেশাজীবী ব্যক্তিদের বিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে শিশুদের মধ্যে সফলতার এবং অনুপ্রেরণার গল্প শোনাতে হবে। এ ছাড়া জাতির জীবিত সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলিষ্ঠ করে তুলতে হবে।

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সে পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানোন্নয়ন খুবই জরুরি।

 

উত্তম শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ। আর এই পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের। পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষানুরাগী সুশীল সমাজ ও সর্বোপরি প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন সাধন করে আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

 

লেখক : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, রায়পুর, লক্ষীপুর। 

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version