জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংকট ও উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। একদিকে সাংবিধানিক সংকট, অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত। সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক দুটি সংকটই মোকাবিলা করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকট মোকাবিলায় যেকোনো ধরনের ভুল সিদ্ধান্তে পুরো জাতিকে চরম মূল্য দেয়ার আশঙ্কা কম নয়।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বাংলাদেশে যে বিতর্ক চলছে তার মূলে যতটুকু রয়েছে যুক্তি তার চেয়ে বেশি রয়েছে অকারণ আবেগ। এ ধরনের বিতর্ক নতুন নয়, অনাকাক্সিক্ষতও নয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনেক পুরোনো। আগে ছিল, তারপর উধাও হয়েছে, এখন আবার এসেছে। তা রক্ষার জন্যই সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ সংকট।
গণতন্ত্র যখন বিপন্ন হয় তখন তা রক্ষার্থে নতুন নতুন পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল এমনই এক সংকট মোকাবিলায়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণমূলক সিদ্ধান্তে তা সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র কখনো দীর্ঘজীবী হয়নি। বিভিন্ন সময়ে তা সংকটের আবর্তে বন্দি হয়েছে। আর গণতন্ত্রের রাজনীতি রাজপথের আন্দোলনের খোরাক হিসেবেই কাজে লেগেছে সব সময়।
এখন সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রসঙ্গে। সরকার মনে করছে, সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষায় সংবিধান মেনে না চলে উপায় নেই। আওয়ামী লীগ ঘোষণাও করেছে সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়া হবে না। সংবিধান মানলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। তবে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই সাংবিধানিক রীতিনীতি মেনে চলার বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান কোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ার সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে কি না?
যদিও বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিচ্ছেন সংবিধানের বিধানমতে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে সংবিধান মেনে কখনোই অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসে না। কাজেই সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই সংবিধান মেনে ন্যূনতম কোনো সমঝোতাকেন্দ্রিক নির্বাচনমুখী হওয়াই যুক্তিসঙ্গত আবেগের বশবর্তী হয়ে দেশ ও জাতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হবে হঠকারিতা।
সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে (ক) উপধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ এক্ষেত্রে শর্তের কথা বলা হয়েছে যে, (ক) উপধারা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপধারায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’ সংবিধানের এই বিধানের কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সংসদ বহাল রেখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন কমিশনও এই মেয়াদের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করবে।
ওই সময়ের মধ্যে সংসদ অধিবেশন হবে না। সংবিধানের ৫৭ (৩) ধারায় বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদেও (সংবিধানে বর্ণিত) কোনোকিছুই অযোগ্য করিবে না।’ তবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান হিসেবে রুটিনমাফিক কাজে ন্যস্ত থাকবেন। সংবিধানের ৭২ (১) অনুচ্ছেদে সংসদের অধিবেশন বসার ক্ষেত্রে ৬০ দিনের বেশি বিরতি থাকবে না বলে উল্লেখ আছে। নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। তবে ওই সময়ে সংসদ সদস্যরা তাদের দায়িত্বে থাকবেন।
এখন প্রধান দুই দলই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে যার যার অবস্থানে রয়েছে হার্ডলাইনে। সংবিধানের ৫৬ (৪)ও ৫৭ (৩) ধারা অনুযায়ী অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে গেলে যদি নির্বাচন নাও হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার দায়িত্ব পালন করে যেতে কোনো বাধা নেই।
কিন্তু কতদিন তারা ক্ষমতায় থাকবেন সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। কাজেই সরকারি ও বিরোধী দলের হার্ডলাইনের অবস্থানে গণতন্ত্রের যাত্রায় হুমকি হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ইতোমধ্যেই বিএনপি নানাভাবে হুমকি দিয়েছে সমঝোতা না হলে সংঘাত অনিবার্য।
আমরা বহুদিন থেকেই সংঘাতহীন রাজনৈতিক পরিবেশ উপভোগ করছি। শান্তিতে বসবাস করছি। কিন্তু নির্বাচন ইস্যুতে আবার কোনো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হোক এটা আমরা কেউই চাই না। ভয়াবহ আকার ধারণ করলে দেশ, জাতি ও জনগণ যে চরম সংকটের মুখোমুখি হবে সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর যদি নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তাহলে সংঘাতের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হয়। সংঘাত নিরসনের অন্যতম উপায় হবে নির্বাচনমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করা।
কারণ আমাদের খেয়াল রাখতে হবে দেশের কোনো রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে কোনো অসাংবিধানিক শক্তি যাতে ক্ষমতা দখল করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতার সুযোগ নেই বললেই চলে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ সহজেই সরকার গঠন করবে। আর বিএনপি ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাবে। এই মুহূর্তে বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি হবে তাদের রাজনৈতিক পরাজয়। রাজনৈতিকভাবে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে। এ মুহূর্তে তাদের গণতান্ত্রিক সহনশীল আচরণের মানসিকতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
গণতান্ত্রিক চেতনা রক্ষার্থে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। সংবিধানে বলা আছে যে, বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক দেশ। যে বিধান সংবিধানে সংযোজন এবং পরবর্তীতে তা বিয়োজন করা হয় সেই বিধান আবার নতুন করে ভিন্ন আঙ্গিকে আনা কি সম্ভব?
নাকি সংবিধান মোতাবেক গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সংবিধানে উল্লিখিত গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচলন অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠান ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিধান অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও তৈরি হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে আমরা ব্রিটেনের কথা বলতে পারি।
সেখানে রেওয়াজ গড়ে উঠেছে যে, নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার আপনাআপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপ লাভ করে। এই সরকার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এমন কোনো কাজ করে না বা করতে পারে না যাতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে নিজের অনুক‚লে তেমন সুবিধা নিতে পারে। কেবল দৈনন্দিন কাজ পরিচালনাই এই সরকারের কাজ।
কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশে বহু আগেই এমন রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। নিশ্চিত সংঘাত জেনে চুপ করে বসে না থেকে সঠিক সময়োপযোগী সিদ্ধান্তই দেশবাসীকে কল্যাণের পথ দেখাতে পারে। কাজেই গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষা করতে গিয়ে কোনো অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সম্ভাবনাকে গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য