-->
শিরোনাম

নির্বাচনের পরিবেশ চাই শান্তিপূর্ণ

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
নির্বাচনের পরিবেশ চাই শান্তিপূর্ণ

নির্বাচন কমিশন অক্টোবরের শেষ অথবা নভেম্বরের শুরুতে সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে। সে হিসাবে সময় ১ মাস ১০ দিনের মতো রয়েছে। এরপর নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় থাকবে সর্বোচ্চ ২ মাস কয়েক দিন। বলা চলে নির্বাচন এখন খুবই কাছের বিষয়। বিরোধীরা যুগপৎ আন্দোলনে এই মুহূর্তে রোডমার্চ করছে। ঘোষণা দিচ্ছে সরকারের পতন ঘটিয়েই তারপর তারা নির্বাচনে যাবে। তাদের এই আকাক্সক্ষা অনেক আগে থেকেই দেশবাসী শুনে আসছে। বেশ কঠোর কর্মসূচি নিয়েও কয়েকবার মাঠে নেমে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।

 

এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার দাবি জানানো হচ্ছে। দাবি না মানলে নাকি পদত্যাগ করাতে বাধ্য করা হবে। এসব কথা এতবার শোনা হয়েছে যে, নতুন করে শোনার মধ্যে তেমন কোনো বিশ্বাস জাগে না। তারপরও ‘পচা শামুকেও’ নাকি পা কাটে। রাজনীতিতে কখন কী হয়, তা দেখার দিব্যজ্ঞান খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। আন্দোলনকারী নেতাদের দিব্যজ্ঞান থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

 

তবে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকরের দাবি নিয়ে ’৯৪-’৯৫ সালে যেভাবে জনগণের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, এর সিকিভাগও এবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনকারীরা সৃষ্টি করতে পারেনি। যতই বলা হোক না কেন যে সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে যাদের বয়স ৩০-এর ঊর্ধ্বে তাদের কাছে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখের হয়নি। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের আমলেই সেনা ক্যু হওয়ার ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। সেই সরকার সংকটটি অতিক্রম করতে পেরেছিল নিজেদের বুদ্ধিমত্তার কারণে। কিন্তু লতিফুর রহমানের দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখেই কেবল নির্বাচন নামক মহড়াটি সম্পন্ন করেছে।

 

কিন্তু সেই নির্বাচনের ভেতরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ভোটার ও প্রার্থীদের কীভাবে নির্বাচনের আগে থেকেই হেনস্তা করা হয়েছিল, সেটি অনেকেই জানেন। নির্বাচনে তো দেশে হত্যা, বাড়িঘর ভাঙচুর, ফলাফল উল্টে ফেলা ইত্যাদি অনেক ঘটনাই ঘটানো হয়েছিল, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সংজ্ঞাতেই পড়ে না। তৃতীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি-জামায়াত যা করেছে, এরপর ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারই আর কোনো নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারেনি। দেশে আরেকটি স্বঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে দুই বছর ছড়ি ঘুরিয়ে গেল। তাদের ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু পারেনি। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এমন অভিজ্ঞতার পর নতুন করে যারা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে মাঠে গলা ফাটাচ্ছেন, তাদের দাবি শুনেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো আগ্রহ ওই সব দল ও জোটের সমর্থক ছাড়া অন্যদের মধ্যে সৃষ্টি করা যাচ্ছে না।

 

তাছাড়া আন্দোলনকারীরা এই পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা কি হবে, সেটাই ঠিক করতে পারেনি। কিন্তু তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এই হুমকি দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ও সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তা তারা প্রতিহত করবেন সে কথাও বলছেন। প্রতিহত করার কথা বললে তো সংঘাত সৃষ্টি অনিবার্য হবেই। সেই সংঘাত ২০১৩-১৪ এর মতো এবার করা যাবে কিনা, সেটি অবশ্য এখনই বলা যাবে না। কিন্তু নির্বাচনকে বিতর্কিত করার কোনো উদ্দেশ্য থেকে এমনটি করা হলে নির্বাচন কমিশন, সরকার এবং অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলো কতটা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে পারবে, সেটি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো ভাবনা-চিন্তা আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই।

 

এসব যৌক্তিক ভাবনা-চিন্তাগুলো সচেতন মহলের মধ্যে কমবেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। এ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও রয়েছে। ঈশান কোণে এক খন্ড কালো মেঘ তো দেখার আগাম অনুমান অনেকেই এখন থেকে করতে পারেন। সেটি তখন হবে কি হবে না, হলে এক খন্ড হবে না বেশি হবে তা তখনই দেখা যাবে। নির্বাচন কমিশন ও সরকার অবশ্য সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেই সবাইকে আশ্বস্ত করছে। বিরোধীরা তাতে আস্থা পায় না, সরকার সমর্থকদের আস্থা-অনাস্থার কোনো নিশ্চিত অবস্থান একরকম কারো মধ্যেই নেই।

 

সরকারি দলের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ জমা হয়েছে। প্রথমত, বিরোধী দল আসলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে, নাকি বাধা দেবে সেটি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। সরকারি দলের জন্য এটি এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব অবস্থা। আন্দোলন আন্দোলন করে শেষে যদি তফসিল ঘোষণার পরই প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে চ্যালেঞ্জ হিসেবে আগামী নির্বাচনকে সরকারি দলের ওপর ছুড়ে দেয়, তাহলে সেটিকে সুশৃঙ্খলভাবে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাতীয় পার্টিসহ আরো যারা নৌকা মার্কায় অংশ নিতে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের কীভাবে সামলাবে সেটি মোটেও সহজ ব্যাপার হবে না। দ্বিতীয়ত, আন্দোলনকারী জোটগুলোর ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি যদি পুরোপুরি থাকে এবং সেটি থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে, তাহলে তাদের প্রার্থিতা নিয়ে খুব বেশি সংকট হয়তো নাও হতে পারে।

 

জাতীয় পার্টি প্রার্থিতার যে সংখ্যা এরই মধ্যে জানান দিচ্ছে, তা দেখে ভোটারদেরই ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। নির্বাচনী হাওয়া কোনদিকে ওঠে, সেটি আগে থেকে টের না পেলে পরে আম ও ছালা যাওয়ার অভিজ্ঞতা নির্বাচনেই যথেষ্ট রয়েছে। সুতরাং এই চ্যালেঞ্জটি আওয়ামী লীগের জন্য তখন সহজ হবে না। কারণ দলের মধ্যেই এখন নানাজনের নানা স্বপ্ন তৈরি হয়ে বসে আছে। ওরা যতই মুখে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার আদর্শের কথা বলুক কিংবা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে গণমাধ্যমে প্রচার করুক।

 

কিন্তু মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনেকেই যে দলের নাক কাটতে মোটেও দ্বিধা করবে না, সেটি অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই বলে দেয়া যায়। নির্বাচন অনেকেরই মাথা ও চিন্তাবোধকে ঘুরিয়ে দেয়। সরকারি দলের ক্ষেত্রে এমন অবস্থাটি বিরোধীদের চাইতে অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার বিরোধীরা যদি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত না আসে, তাহলে তারা তো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না। নির্বাচনটি প্রতিহত করার জন্য সব শক্তিই প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে।

 

ইউরোপী ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব সেরকম পরিস্থিতিতে তাদেরই অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে বসবে। ইইউর সংসদ যেখানে বাংলাদেশের বিচারালয়ের একটি রায়কে নিয়ে যে ধরনের অযাচিত মন্তব্য করেছে, সেটি স্বাধীন-সার্বভৌম ইউরোপীয় কোনো রাষ্ট্রের ব্যাপারে তারা করতে যাবে বা পারবে কিনা, করলেও থোড়াই সেটিকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বিবেচনায় নেবে- এমনটি ভাবা যায় না। কিন্তু তারা তো বাংলাদেশের আদিলুর রহমানকে ২০১৩-এর ৫ মের অপপ্রচারের সব অভিযোগ থেকে খালাস দেয়ার জন্য দাবি করে বসে আছে।

 

কেন তারা করছে এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই আমাদের জানা আছে, তাদেরও জানা আছে। কিন্তু তারা তাদের স্বার্থেই মানবাধিকার, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, ন্যায়বিচারকে নিক্তিতে ওঠায়, নামায় বা ছুড়ে ফেলে দেয়। এর প্রমাণ তো এ দেশের মানুষ স¤প্রতি দেখেছে। সেটাই এখন ঈশান কোণে আরেকটি কালো মেঘের আভাস দিচ্ছে।

 

এমনিতেই বছরটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষে বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ এ নিয়ে বেশ চাপে আছে। ফলে এর প্রভাব নির্বাচনেও একেবারেই পড়বে না, তা বলা যাবে না। ব্যবসায়ীরা আসলে সরকারবান্ধবও নয়, জনবান্ধবও নয়, তারা নিজেদের আখেরই কেবল গুছিয়ে নিতে চায়। এই অপকর্মটি আগেও করেছে, এবারো সেটি তারা লাগামহীনভাবে করছে। এটি নির্বাচনের বছরে ঈশান কোণে কালো মেঘ হিসেবেই দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে কিছু কিছু ব্যক্তি এরই মধ্যে আনুগত্যের প্রমাণ দেখাতে গিয়ে যা করেছে, তা আওয়ামী লীগের জন্য ভালোর চেয়ে মন্দই বেশি ডেকে আনছে। এটি কি তারা ইচ্ছা করে করেছেন, নাকি নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ দিয়েছেন তা বোঝা গেল না।

 

তবে প্রশাসনের ভেতরে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধাচারীরা কি করছেন বা করবেন তা আপাতত আমাদের জানা নেই। যদি কিছু করেনও কাউকে জানিয়ে করবেন না। এতটা বেকুব তারা নয়। আর অন্যদিকে জঙ্গি নানা গোষ্ঠী আবারো তৎপর হয়ে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, অপপ্রচার, গুজব, মিথ্যা, ঘৃণার বান ভেসে যাচ্ছে। যতই নির্বাচন আরো তীরে ভেড়ার কাছাকাছি পৌঁছাবে, ততই এসব দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের নানা অবিশ্বাস্য কর্মকান্ড, ঘটনা, দুর্ঘটনা এবং নির্বাচনকে নিয়ে অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা কিংবা বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টির ব্যাপারস্যাপার যে ঘটবে না, তা বলা যাবে না। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগ কিংবা জোট-মহাজোটের প্রস্তুতি বা করণীয় কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা চোখে পড়ে না। বক্তৃতায় যা কিছুই বলা হোক না কেন, তা দিয়ে চিড়া ভিজবে না।

 

এবারের নির্বাচনে বুদ্ধি, মেধা, সততা, যোগ্যতা এবং পরবর্তী ৫ বছরে দেশে কীভাবে উন্নয়ন, গণতন্ত্র, সুশাসন, কর্মসংস্থান, মানসম্মত শিক্ষা, অসা¤প্রদায়িকতা এবং আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানো হবে, সেই রূপকল্পের প্রচার ও জনগণকে আশ্বস্থ করার বিষয়টি এখন থেকেই দেশব্যাপী করার কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version