মানুষের জীবন জটিল হচ্ছে ক্রমশ, বিশেষ করে নগর জীবন। রাজধানী ঢাকায় কমপক্ষে দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর বাইরেও প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক লোক ঢাকায় আসে নানা সমস্যার সমাধানকল্পে। কেননা, প্রায় সব কাজ হয় রাজধানীকেন্দ্রিক, তা সে উন্নত চিকিৎসা থেকে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য বেচাকেনা অথবা ভাগ্যান্বেষণ- যাই হোক না কেন।
ফলে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জট ও জটিলতা ক্রমশ বহুমুখী ও বহুধা বিস্তৃত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা এমনিতেই সংখ্যাধিক্যে ভারাক্রান্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানাবিধ দূষণ ও দখল। যেমন- বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, নদীদূষণ, পয়ঃবর্জ্যদূষণ, যানবাহন সংকট, দুর্বিষহ যানজট, শ্রম ঘণ্টা ও জীবনীশক্তির অপচয় ইত্যাদি।
ফলে, মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন, সমাজজীবন, চাকরিজীবন, কর্মজীবনে নানাভাবে চাপ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্ত হচ্ছে বিষাদগ্রস্ততা। এর পাশাপাশি রয়েছে নিঃসঙ্গতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পারস্পরিক দূরত্ব, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি।
উপরোক্ত সমস্যাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক সভ্যতা ও প্রযুক্তি। যেমন- স্মার্ট ফোন, ফেসবুক আসক্তি, টিকটক ভিডিও, কম্পিউটার-ইন্টারনেটের প্রতি নির্ভরশীলতা। কোভিড-১৯ পরবর্তী বিপর্যস্ত বিশ্ব ব্যবস্থা, আর্থিক মন্দাবস্থা, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত-সংঘর্ষ তো আছেই। বাস্তবে এসবই মানুষকে আদৌ সুস্থির থাকতে দিচ্ছে না। বরং ক্রমাগত সৃষ্টি করছে মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, অশান্তি যা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে তৈরি করছে বিষাদ, বিষণ্ণতা, হতাশা।
ফলে মানুষের মধ্যে অন্যান্য শারীরিক অসুখ-বিসুখ বাসা বাঁধছে। আরও জটিল ও বহুমুখী হচ্ছে রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা। যেমন- একই সঙ্গে ফুসফুস, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস, লিভার ও কিডনির সংক্রমণ। ফলে, চিকিৎসা হচ্ছে জটিল বিশেষায়িত ও ব্যয়বহুল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমাগত মানসিক চাপ বৃদ্ধি এবং বিষণ্ণতা মানুষের অন্যান্য রোগ-ব্যাধিকে আরও জটিল ও বহুমুখী করে তুলেছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বের ২০০ কোটির বেশি মানুষ মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা ও বিষাদগ্রস্ততায় আক্রান্ত, যেটি মূলত একটি মানসিক ব্যাধি। এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না বাংলাদেশেও।
যেভাবে মানসিক রোগী বাড়ছে, সেভাবে বাড়ছে না এর চিকিৎসা ব্যবস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি আটজনের এক মানসিক রোগে ভুগছেন। বয়স্কদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং শিশুদের মধ্যে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন না ৯১ শতাংশ রোগী। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৯-এর জরিপ অনুযায়ী দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। শতকরা হিসেবে তা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ১৭ কোটির বেশি মানুষের মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৭০। কাউন্সেলিংয়ের সাইকোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ২৫০।
সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল আছে দুটি- ঢাকা ও পাবনায়। সেখানেও রয়েছে নানা সমস্যা। বেসরকারি খাতের অবস্থা আরও শোচনীয়। সে অবস্থায় বর্তমান জটিল ও সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে সুস্থির শান্তিপূর্ণ জীবনের প্রত্যাশা সুদূরপরাহত বলেই মনে হয়।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য