-->
শিরোনাম

গণআন্দোলন মাটিতেও ফেলে দেয়!

আহসান কবির
গণআন্দোলন মাটিতেও ফেলে দেয়!

প্রিয় পিতা,দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আজ আপনার সামনে হাজির হয়েছি। আপনি কি কখনও কল্পনা করেছিলেন যে ১৯৭৫-এর পর ২০২৪ সালের একই মাসে আপনি আপনার কন্যার হাতে দ্বিতীয়বার নিহত হবেন? কখনও কি ভেবেছিলেন পাকিস্তানি কিংবা আপনার শত্রুরা যা করতে পারেনি আপনার কন্যা সেটা করে দেখাবে? আপনাকে সীমাহীন নিগ্রহ ও লাঞ্ছনার মুখোমুখি করবে? অথচ একাত্তরে বাংলার মাটিকে মুক্ত করে ছাড়ার যে স্বপ্ন আপনি দেখিয়ে ছিলেন, ২০২৪ সালে সেটিও করে দেখিয়েছে ‘জেন জেড’ নামের এক জেনারেশন, যাদের বয়স বারো থেকে সাতাশের ভেতর, যাদের স্বপ্ন আর আর রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে আপনার গড়া দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন আপনার কন্যা শেখ হাসিনা।

বাংলা শাসন করা শেষ বাঙালি রাজা লক্ষণ সেনের পর দ্বিতীয়বার এমন ঘটনা ঘটালেন আপনার কন্যা। আটশত বছর পর। একেবারেই নতুন প্রজন্মের এই ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন দেখে আপনার কথাই মনে পড়েছেÑ ‘আর মনে রাখবা সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরে কেউ দাবায়ে রাখবার পারবা না’! গণ-আন্দোলনে রাজপথে নেমে ‘জেন-জেডের’ স্বপ্নবাজ ছেলেমেয়েরা বারবার যেন আপনার কাছেই ফিরেছে। পাকিস্তানিদের মতো ক্ষমতার দম্ভ এবং অহমিকায় আপনার কন্যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীদের সামান্য ‘দাবি’ই বুঝতে পারেননি।

সংবাদ সম্মেলনের নামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের তাচ্ছিল্য করা এবং ‘রাজাকার’ ট্যাগ লাগানোর পর সীমাহীন প্রতিক্রিয়া হয় জেন-জেডের মুক্তিপাগল ছেলেমেয়েদের মধ্যে। তারা তাদের সর্বোচ্চ আয়োজন নিয়ে নেমে আসে রাস্তায়। মনোভাব ঠিক এমনÑ ‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’।

গণআন্দোলনের জন্য একটা স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন হয়। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে যেমন ছিলেন ডা. মিলন ও নূর হোসেন। নির্মমভাবে সেই স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেন শেখ হাসিনা নিজে, শহীদ নূর হোসেনের সাহস ধার করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ নামের যে ছেলেটা বুক চিতিয়ে দুই হাত তুলে পুলিশের সামনে দাঁড়ায়, তাকে অমানবিকভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করে পুলিশ!

শিক্ষার্থীদের বুকের রক্তে লাল হতে থাকে খোলা রাজপথ। মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকা জেন-জেডের ছেলেমেয়েরা ফিরে যায় আপনার কাছেই। তারা ঘোষণা দেয়, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, বাংলার মাটিকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’!

পিতা,এরপরও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং কমেডি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। ডিবি অফিসের ‘ভাতের হোটেল’ খ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন উর রশীদ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে তুলে আনেন। তারা অনশন করলেও তাদের খাওয়ার ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয় যোগাযোগমাধ্যমে, পত্রিকায়। তারা আন্দোলন তুলে নিয়েছেন এমন বিবৃতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়! এরপর শত শত মানুষ নিহত হলে ঘোষণা দেওয়া হয়Ñ গণভবনের দরোজা খোলা। আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছেলেমেয়েরা আপনার অমর ভাষণের একটা অংশ উদ্ধৃতি দিয়ে ছড়িয়ে দেয় যোগাযোগমাধ্যমে! ‘অ্যাসেম্বলি কল করলেন, রক্তের দাগ শুকায় নাই।... বাঙালির রক্তের ওপর পাড়া দিয়া শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাসেম্বলিতে যোগদান করবে না’-এর মতো’- শত শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে ছাত্ররা কেউ আলোচনায় বসবে না’!

রোম যখন পুড়তে থাকে নিরোরা তখন বাঁশিই বাজায়। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্নই তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। রাজপথে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের সাহস আর রক্তই হয়ে দাঁড়ায় আসল নিয়ামক। কারফিউ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, পেটোয়া বাহিনী, তাঁবেদার আর মিডিয়ার স্তাবক কাউকে দিয়েই শেষমেশ শেখ হাসিনার শেষ রক্ষা হয়নি। তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। পিতা, আপনি জানতেন যে তীব্র গণআন্দোলন জনতাকে শুধু বুকেই টানে না, কাউকে কাউকে মাটিতেও ছুড়ে ফেলে দেয়!

মানুষ শুধু আপনার কন্যাকেই ছুড়ে ফেলেনি, তার নির্দেশ মতো আওয়ামী লীগের যে কর্মীরা আন্দোলনে গিয়ে নিহত হয়েছেন, যে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রাণ দিয়েছেন, হয়তো তাদেরও ছুড়ে ফেলে দিয়েছে নতুন স্বপ্নে বিভোর মানুষ।

আন্দোলনে নিহত শত শত মানুষের জন্য কেঁদেছে বেঁচে থাকা কোটি কোটি মানুষ। যে আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা নিহত হয়েছেন তাদের জন্য যেন একফোঁটা অশ্রুজলও থাকতে নেই। তাদের কথা কেউ বলছেন না! এই সুযোগে হামলা হয়েছে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতেও।

পিতা, আগেই লিখেছি মানুষ আপনার কন্যার কৃতকর্মের জন্য আপনার ওপরও চড়াও হয়েছে। ২০০৮-এর পর থেকে গত ষোলো বছরে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। একটি নির্বাচনও মানুষের জন্য হয়নি, মানুষ ভোট দিতে পারেনি। ২০১৪ পরবর্তী নির্বাচন ছিল প্রহসনের নির্বাচন, ২০১৯-এরটা ছিল মধ্যরাতের নির্বাচন আর ২০২৪ সালের নাম ছিল ডামি ভোটের নির্বাচন। জিতলেও আওয়ামী লীগ হারলেও আওয়ামী লীগ। এমন এক আজব সমীকরণ তৈরি করেছিলেন আপনার কন্যা।

পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক প্রচার ছিল। শতবার বলা হয়েছে এটা নির্মিত হয়েছে নিজস্ব অর্থায়নে। এরপর রাস্তা, ব্রিজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, টানেল, অনেক নির্মাণ বা উন্নয়নের গল্প শোনানো হয়েছে। বিদেশি নির্ভরযোগ্য মিডিয়ার বরাত দিয়ে এখন বলা হচ্ছে বাংলাদেশের ঋণ নাকি ১৩ লক্ষ কোটি টাকার বেশি! এই ঋণ কীভাবে শোধ করবে মানুষ? দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা তছনছ করা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীকে স্তাবক ও পেটোয়া এবং ২০০৯-এর বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর বিজিবিকে ‘ভীরু ও পিঠ দেখানো’ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি আর সিন্ডিকেটবাজিতে নাভিশ্বাস উঠেছিল সাধারণ মানুষের। সব সেক্টরে স্তাবক ও তাঁবেদার তৈরি, মিডিয়ার সীমাহীন তেলবাজি, মানুষকে ‘দাবিয়ে রাখার’ কৌশলে মানুষের দীর্ঘশ্বাস বোঝা কিংবা দেখার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন আপনার কন্যা।

আপনার কন্যার পলায়নের পর মানুষের রাগ তাই আপনার ওপরই গিয়ে পড়লো। মারমুখো জনতা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল আপনার একাধিক ভাস্কর্য, মুরাল, মূর্তি, বীর শ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্যসহ আরও অনেক কিছু। লুট হলো গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। পুড়িয়ে ছাই করলো স্বাধীনতার সূতিকাগার খ্যাত আপনার বাড়ি, যা পরে জাদুঘর হয়েছিল।

কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় যেমন আছেÑ ‘মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না কিচ্ছু থাকে না, খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নেই।’

প্রিয়,আর যেন কিছু নেই আপনার। আপনি এখন এক বিরাণভূমির অসহায় পিতা, আপনার ছেলে ও একান্ত স্বজনরা আগেই নিহত হয়েছে, আপনার কন্যারা চলে গেছে, নাতিরাও দেশের বাইরে। আপনি আবারও চিরনিঃস্ব, নিহত জনক অ্যাগামেমনন!

আপনার কন্যা ইলেকট্রা খ্যাত শেখ হাসিনা এখন দেশের সবচেয়ে অজনপ্রিয় একজন মানুষ, যার হাতে লেগে আছে শত শত ছাত্র জনতার রক্ত, যার বিরুদ্ধে খুনের মামলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা হবে! পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পরেও আওয়ামী লীগ বা আপনার ভক্ত-অনুসারীরা এত বিপদে পড়েনি, ২০২৪-এর পাঁচ আগস্টের পর যতটা পড়েছে। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের পর আপনি ছিলেন না, শোক দিবস ছিল না, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে ছিলেন চির অমøান। প্রায় সব জেলার, প্রায় সব মহল্লায় মাইকে বাজতো আপনার দেওয়া সাতই মার্চের কালজয়ী ভাষণ, শোক মিছিল, র‌্যালি আর ছিল কাঙালিভোজ।

২০০৯ থেকে ১৫ আগস্টে ছিল জাতীয় শোক দিবসের ছুটি। ফুল দেওয়ার প্রতিযোগিতা হতো, প্রশাসন যন্ত্র, সব বাহিনী আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভেঙে পড়তো। ২০২৪-এ এসে এই ছুটি বাতিল হওয়ার পর আপনার জন্য নির্মিত জাদুঘর বা আপনার মাজারে কয়জন ভিড় করবে জানি না। হয়তো ফুল দেওয়ার হিড়িক পড়বে না। অথচ আপনার জন্মশতবর্ষ পালনের নামে এ দেশে শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে, আনুষ্ঠানিকতার নামে আপনাকে মানুষের হৃদয় থেকে ক্রমাগত টেনে নামানো হয়েছে।

মহাকাল বিচার করবে কন্যার ভুলের জন্য আপনার প্রতি লাঞ্ছনা কিংবা শোক দিবসের ছুটি বাতিল করা ঠিক হয়েছে কিনা। জানি না আপনার বাড়িতে বা কবরে ফুল দিতে গেলে সরকারিভাবে বাধা আসবে কিনা। কিন্তু যা থাকে হৃদয়ে, বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান তার সবটা মুছে দিতে পারে না। হয়তো আপনি বেঁচে থাকলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সব শহীদদের জন্য আপনার মন কাঁদতো, হয়তো তাদের দাবির প্রতি আপনি একাত্মতা প্রকাশ করতেন। হয়তো জেন-জেডের ছেলেমেয়েরাই একদিন ভাববে বাংলার স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষটার সঙ্গে এমন করা ঠিক হয়নি। আহমদ ছফা যেমন লিখেছিলেন তেমন করে হয়তো তারা ভাববেÑ কোনো এক বাবা তার ছেলেকে গনগনে সূর্যটাকে দেখিয়ে যেমন বলেছিল, ওই সূর্যটার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

পিতা,আপনার প্রতি বিশ্বাস হারাইনি কখনও। চোখের জলে নিজেদের কথা লিখছি বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ২০০৩-০৪-০৫ সালে যখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল, যখন দলটা স্তাবক, চাটুকার বা পেটোয়া বাহিনীতে ভর্তি ছিল না। তখন বিচিত্রায় কার্টুন আঁকতো আমার ভাই আহমেদ কবীর কিশোর ওরফে কার্টুনিস্ট কিশোর। জঙ্গিবাদবিরোধী সবচেয়ে বেশি কার্টুন কিশোরের আঁকা। কখনও বলিনি, আজও বলবো না ২০২০-এর মে মাসে কিশোরকে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কোন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল, কতখানি বেদনা নিয়ে কিশোরের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত লেখক ও বাংলাদেশের প্রথম কুমির ব্যবসায়ী মুশতাক আহমেদ জেলে মারা গিয়েছিল। মুশতাক মারা যাওয়ার পর ২০২১ সালের মার্চ মাসে কিশোর জামিন পায়। কিশোর এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে, এক কানে শুনতে পায় না। রিফিউজি স্ট্যাটাসে সে এখন সুইডেনের বাসিন্দা।

প্রিয় পিতা, আজ বলতে আসিনি কিশোর জেলে থাকার সময় কী যাতনা ভোগ করেছে আমার পরিবার, বিচার চেয়ে কেন আমাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। তখন মনে হয়েছিল বিচার বিভাগকেও কু-শাসনের সিঁড়ি বানিয়েছে আপনার কন্যা।

একাত্তর সালে আপনার ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিল লক্ষ তরুণ। যার ভেতরে আমার বাবা-চাচাও ছিলেন। সার্টিফিকেট ভাঙ্গিয়ে আমরা কোনো সুবিধা নিতে যাইনি। আপনার এই মৃত্যুদিনে বাবা ও চাচার কথা মনে করে আমার ও কিশোরের পক্ষ থেকে দুটো গোলাপ নিয়ে আমি আপনার পুড়ে যাওয়া বাড়ির সামনে দাঁড়াবো! দোয়া করবেন যেন বাংলাদেশটা পথ না হারায়! দোয়া করবেন যেন গোলাপের গন্ধে ঢাকা পড়ে যায় আপনার বাড়ি পোড়া ঘ্রাণ!লেখক : রম্যলেখক

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version