সরকার পরিবর্তন হলেই, পাহাড়ের তিন পার্বত্য জেলায় অন্তর্বর্তীকালীন পার্বত্য জেলা পরিষদও পুনর্গঠন হতে দেখা যায়। কোনো সরকারই নির্বাচনের মাধ্যমে পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনের পথে যায়নি। যখন যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করেছে, সেই রাজনৈতিক দলই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে, নিজেদের লোক দিয়ে গঠন করে, অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে করেছে। ফলত পরিষদগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের ‘পুর্নবাসন কেন্দ্রে’ পরিণত হলেও পাহাড়িদের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনে, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নেতাকর্মীদের থেকে মনোনয়ন করে থাকলেও, যোগ্য কর্মীকে দিয়ে পরিষদ গঠন করেছেন এমন উদাহরণ বিরল। অধিকাংশ পরিষদ ‘বোতল মার্কা’ বলে নাম পেয়েছে এবং বোতল মার্কাদের দিয়ে গঠন করা ওই সব পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা মিটিং, সেমিনারে খেয়ে-দেয়ে চোখ লাল করে অতিথি হিসেবে কাটিয়ে দিয়েছেন। ফলে খুব বেশি দরকার না হলে, বিপদে না পড়লে কাউকে পরিষদমুখী হতে দেখা যায়নি।
পাহাড়ের জাতিগোষ্ঠীগুলো নানাভাবে বঞ্চিত। বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম করে পেয়েছিল স্থানীয় সরকার পরিষদ, পরে পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু সরকার, বিশেষ করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে নিজেদের লোকজন দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠন করে পরিচালনা করেই চলেছেন, যুগের পর যুগ।
তিন পার্বত্য জেলায় পরিষদ গঠনের পর থেকে আজ পর্যন্ত যতবার অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠিত হয়েছে, খুব কমই যোগ্য ও শিক্ষিতজনকে চেয়ারম্যান এবং সদস্য হিসেবে মনোনয়ন করতে দেখা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, যা শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত, হওয়ার আগ পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদের যোগ্য চেয়ারম্যান হিসেবে মাত্র একজনকে আমরা সকলে এখনো স্মরণ করে থাকি, তিনি হলেন গৌতম দেওয়ান। আর চুক্তির পর থেকে এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যানদের মধ্যে অধ্যাপক মানিক লাল দেওয়ান ছাড়া কাউকে যোগ্য চেয়ারম্যান ছিলেন বলতে শোনা যায় না। উল্লিখিত এই দুইজনই রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাকি দুই পার্বত্য জেলা পরিষদের কোনো চেয়ারম্যান, মেম্বার সেভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন বলে বলতে পারছি না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সুনাম শুনতে পাওয়া যায়। তার আগে-পরে আর কাউকে প্রশংসিত হতে দেখা যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে মনি স্বপন দেওয়ানের নাম সবার আগে স্থান পাবে বলে অনেকের মতো আমারও ধারণা। তিনি যদিও বিএনপি সরকারের আমলে উপমন্ত্রী পদে ছিলেন মাত্র। বাকি কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীকে পাহাড়ে সমাজের প্রয়োজনে মিলেমিশে গঠনমূলক কাজ করার চেষ্টার জন্য প্রকাশ্যে কাউকে সুনাম বা প্রশংসা করতে দেখা যায় না। সে দিক থেকে বিচার করলে পাহাড়ের জনগোষ্ঠীগুলো খুব কমই উল্লেখ করার মতো যোগ্য প্রতিনিধি পেয়েছে।
নিকট অতীতে পার্বত্য জেলা পরিষদের কিছু চেয়ারম্যানকে পাওয়া যাবে, যাদের নিয়ে সমাজে নানান হাস্যরস চালু আছে, যাদের দুয়েকজন সারাক্ষণ ‘বোতলে’ ডুবে থাকতে পছন্দ করতেন বলে শুনতে পাওয়া যায়। এবং তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গরাও সেই ‘মার্কা’ হওয়ায় ভালো মানুষদের কেউ ওই প্রতিষ্ঠানের দিকে পা বাড়াতে পছন্দ করতেন না।
বাংলাদেশের এককেন্দ্রিক শাসন-পদ্ধতির মধ্যেও বহুজাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের একটি সুন্দর উদাহরণ হলোÑ পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু এই পরিষদগুলোতে অযোগ্য লোকজনদের দিয়ে পচানো হয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য লোকেরাও আর চেয়ারম্যান পদে বসতে অনাগ্রহী হয়ে যান।
যোগ্য লোককে চেয়ারম্যান আর সদস্য মনোনয়নের উদাহরণ না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব দিনকে দিন কমছে। কদাচিৎ যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন করতে চাইলেও সরকার পারছেন না, এমন উদাহরণও বিরল নয়। যেমন, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব মুক্তিযোদ্ধা উক্য জেনকে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান হিসেবে মনোয়ন করতে চাইলে, তিনি বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বলে আমরা জানি। একইভাবে, সাবেক অতিরিক্ত সচিব শরদিন্দু শেখর চাকমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে চাইলে, তিনিও নিতে চাননি বলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমাকে।
বিগত সরকারগুলো অযোগ্য, অগ্রহণযোগ্য নেতাকর্মীদের দ্বারা পরিষদসমূহ পরিচালনা করতে গিয়ে, এখন যোগ্য, শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গরা জেলা পরিষদের দায়িত্ব নিতে আর আগ্রহী নন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছেন। তারা প্রত্যেকে পাটির কর্মী হওয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, পুনরায় জেলা পরিষদগুলোকে নতুন চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সমন্বয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পুর্নগঠন করবেন বলে গুঞ্জন বিদ্যমান। পার্বত্যবাসীদের প্রত্যাশা থাকবে, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ যেন যোগ্য-শিক্ষিত এবং পরিচিত ভালো মানুষের দিয়ে গঠন করা হয়।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মনোনয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার গুরুদায়িত্ব পালনের সুযোগ আছে বলে মনে করি। প্রধান উপদেষ্টাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার সামনে পাহাড়ের চারটি প্রতিষ্ঠানের চারজন চেয়ারম্যান ও সদস্য মনোনয়নে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনার করে একটি সুন্দর উদাহরণ সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।
এতকাল রাজনৈতিক কর্মীদের থেকে মনোনীত চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের গুরুত্ব অনুধাবনের বদলে পরিষদগুলোকে দিনকে দিন অবমূল্যায়নই করেছেন। পরিষদের অধীনে বিভিন্ন পদে নিয়োগ বাণিজ্য চালু থাকায়, পার্বত্য তিন জেলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। ফলে আজ খুব কম স্কুলে যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যাবে।
বর্তমানে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ ১ জন চেয়ারম্যান ও ১৪ জন সদস্য নিয়ে মোট ১৫ সদস্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন জেলা পরিষদ গঠিত হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের আইনের আলোকে বাঙালিসহ বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের মধ্য থেকে মোট ১৪ জন সদস্য মনোনীত করা হয়। ২টি সদস্য পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে মোট ২৮টি হস্তান্তরিত বিভাগ রয়েছে। আর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে রয়েছে ২৪টি হস্তান্তরিত বিভাগ। এই হস্তান্তরিত বিভাগগুলোকে জেলা পরিষদ তদারকি এবং সমন্বয়ের কাজটি করে থাকে। এছাড়াও সরকারি বরাদ্দের পাশাপাশি নিজস্ব আয়ের মাধ্যমে নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কাজ করা হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদের কর্ম পরিধি বিবেচনায় যোগ্য সদস্যদের মনোনয়ন একটি সময়ের দাবি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বারা গঠিত পরিষদে যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন করা গেলে আগের ক্ষতিগুলোকে কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে বলে অনেকের ধারণা। তাই তিন পার্বত্য জেলার জন্য চারজন সম্মানিত, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে চারটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করা হোক। পাশাপাশি জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক সদস্য নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য শিক্ষিতজনদেরকে মনোনয়ন করা আবশ্যক। আর নয় বশংবদ প্রতিনিধি, সুন্দর একটি গঠনমূলক দৃষ্টান্ত সৃষ্টির মাধ্যমে পরিষদে প্রতিনিধি মনোনয়ন করা হোক, যা আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলোকেও অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। সম্ভব হলে প্রথমবারের মতো এক বা একাধিক নারী চেয়ারম্যান মনোনীত করা হোক। সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। কাউকে পেছনে ফেলে নয়।
লেখক : উন্নয়ন সংগঠক।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য