-->
শিরোনাম

আসুন বই না পুড়িয়ে ভূত তাড়াই

আলমগীর খান
আসুন বই না পুড়িয়ে ভূত তাড়াই

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনে ব্যাপকতম মানুষের সমর্থন সঞ্চয় করে যে সাফল্যলাভ করেছে তা অভূতপূর্ব। মানুষের মনে বৈষম্যহীনতা, সাম্য, শান্তি, নৈতিকতা ও সমৃদ্ধির যে মৌন স্বপ্নকে জাগিয়ে দিয়েছে এ আন্দোলন ইতিহাসে তার আবির্ভাব অনেকদিন পরপর হয়। কিন্তু এ আন্দোলনের অনেকগুলো শক্তির পাশাপাশি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতাও লক্ষ্যণীয়। আবার অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের দুর্বলতা ছিল আন্দোলনকারীদের সবচেয়ে বড় শক্তি। অবশ্যই ক্ষমতাসীন শক্তির বন্দুক, লাঠিসোটা, ভয়ঙ্কর পাহারাদার ইত্যাদির কমতি ছিল না। কিন্তু তারা হারিয়েছিল মানুষের বিশ্বাস ও নির্বাচনি প্রহসনের মাধ্যমে অর্জিত ক্ষমতায় থাকার বৈধতা। তাদের গণবিচ্ছিন্নতা, দম্ভ, চিরকাল ক্ষমতায় থাকার মুর্খ ধারণা, নিজের পরিবর্তে বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা, দেশব্যাপী যথেচ্ছ লুণ্ঠনবৃত্তি, মুক্তিযুদ্ধ-রাজাকার বিভাজনের নোংরা খেলা ইত্যাদি কাল হয়ে দাঁড়ায়।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন শক্তির ওই জাতি বিভাজনের নোংরা খেলাটি তিনি ধরতে পারেননি, বরং তাতে নিজেকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে বসে বসে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছিলেন বলেই অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়। তিনি একা নন, আরও অনেকেই এমনটা করেছেন। সমাজে যখন পরিবর্তনের ঢেউ লাগে তখন ক্ষমতাসীনদের কোলে বসে সুখ ভোগ করা লেখক-বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না বলে পরিবর্তিত সময়ে ঘৃণার পাত্র হন। কারণ বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ড লৌহকঠিন করে বানানোর গ্যারান্টি কেউ না দিলেও জনসাধারণ তাদের কাছে তেমনটাই প্রত্যাশা করে, যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে তারা হতাশও হয়। তাদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে ও কখনোবা উন্মত্ততাকে স্পর্শ করে। যা ঘটছে জাফর ইকবালকে নিয়ে এখন।

এক অদূরদর্শী পক্ষের জাফর ইকবালের বই পোড়ানোর উন্মত্ততায় মেতে ওঠার কারণ তার কাছে প্রত্যাশা ছিলো অনেক, অথচ সেই প্রত্যাশার শিখায় পানি ঢেলে দিয়েছেন তিনি মোহান্ধতা, সুখান্ধতা ও দলান্ধতার জন্য। সেজন্য তরুণ-কিশোরদের কাছে প্রিয়তম লেখকটিকে বর্তমানে তার ভুলের ও নির্বুদ্ধিতার জন্য এই কড়া মাশুল দিতে হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে থাকা অবস্থায়ই বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে তার অবিবেচনাপ্রসূত-অশিক্ষকসুলভ মন্তব্যের জন্য অনেক প্রকাশনা সংস্থা তার বই সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এটি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। যারা জাফর ইকবালের বই আর পড়বেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদেরও সেটি গণতান্ত্রিক অধিকার। আমি তার চমৎকার গল্প ‘দীপু নাম্বার টু’ অনেক বছর আগে মুগ্ধ হয়ে পড়েছি, এরপর আর দুয়েকটা মাত্র।

এখন তাকে পড়ার আর কোনো প্রয়োজন মনে করি না সাম্প্রতিক এই জাফর-বিরোধিতার অনেক আগে থেকেই। কিন্তু একই সঙ্গে এও মনে করি, তার আরও লেখা প্রয়োজন, বিশেষত বিজ্ঞানকে শিশু-কিশোরদের কাছে আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে তুলে ধরার ক্ষমতার জন্য। তার বইগুলো এ দেশে শিশুকিশোরদের উদার দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানমনস্ক একটি প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য তার বই পোড়ানোর এসব উন্মত্ত কর্মকাণ্ড প্রতীকী হলেও সঠিক নয়। একটি শিশুকিশোর প্রজন্মের বিকাশকে যা বাধাগ্রস্ত করবে।

এক্ষেত্রে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বি হওয়াইতো একটা সমস্যা যা পূরণ না হলে আবার যে ক্ষোভ তৈরি হয় তা-ও আকাশচুম্বি। বুদ্ধিজীবীদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কতটা হলে বাস্তবসম্মত হবে তার দিকনির্দেশনা আছে ১৯৭২ সালে লেখা আহমদ ছফার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ের বিখ্যাত শুরুর বাক্যেই: “বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।” বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরাও তাই সঠিকভাবেই মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথায় কান দেয়নি, বরং প্রতিবাদী হয়েছে।

ছফার কথায়: “কবি, সাহিত্যিক, লেখকেরা গর্ভিণী নারীর মতো। তারা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার বেঁচে থাকার ভ্রুণকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কবি, সাহিত্যিক, তেমন উপন্যাস লিখিয়ে কিংবা গাল্পিক কি আছেন? নেই।” তখনও ছিল না, এখনো নেই। তবু মানুষের মন মানে না কারণ থাকা উচিত তো। তাই এত ক্ষোভ মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর।

সেসময় ছফা আরও লিখেছিলেন, “রাষ্ট্রীয় দর্শন আওড়ালে, প্রশংসা করলে পয়সা পাওয়া যেত। তাই তারা দরাজ গলায় এমন একনিষ্ঠভাবে রাষ্ট্রীয় দর্শনের গুণ বাখান করতেন। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় দর্শনকে সত্য প্রতিপন্ন করার জন্য অনেক খ্যাতনামা পণ্ডিত ব্যক্তি এবং বিদগ্ধজন কত অকাজ-কুকাজ করেছেন একটা দৃষ্টান্ত দিলেই পরিষ্কার হবে।” এখনও এমন দৃষ্টান্ত ভুড়িভুড়ি।

তবে মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর্থিক-সামাজিক কোনো অকাজ-কুকাজ করেছেন এ কথা কেউ বলতে পারবেন না। দেশের মানুষকে দুই শত্রুশিবিরে বিভক্ত করার খেলায় তিনি অংশগ্রহণ করেছেন অবশ্য। তিনি যে কাজটি ভাল পারেন, শিশুকিশোরদের জন্য আকর্ষণীয় গল্প লেখা, সে কাজের জন্য এ খেলায় অংশগ্রহণ তার দরকার ছিল না। তার বইগুলো কোনো সমস্যা তো নয়ই, বরং এমন বই আরও হাজার হাজার প্রয়োজন। অথচ দেখুন, কোন রাগ কার ওপরে গিয়ে পড়ছে।

যারা এই পরিমাণে ক্ষেপে উঠেছেন, তারা ক্ষিপ্ততার চোটে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিটা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলছেন? পরাজিত শক্তিকে ফ্যাসিবাদ বলে গাল পেড়ে নিজেরাও কি অজান্তে একই চরিত্র প্রকাশ করছেন না? বই পোড়ানো বিশ্বের এক অতি পুরনো অপসংস্কৃতি মধ্যযুগে পরদেশ ও পরসম্পদ লুণ্ঠনকারীরা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বাগদাদ হয়ে নালন্দা পর্যন্ত পৃথিবীবিখ্যাত গ্রন্থাগারসমূহের অনেক অমূল্য মানসসম্পদকে চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছে; যে ক্ষতি অপূরণীয়। ইতিহাস বলছে, বাঙালি কখনো পরদেশ ও পরসম্পদ লুণ্ঠনকারী ছিল না। নাকি সুযোগ পায়নি? জাফর ইকবালের লেখা বই পোড়ানোর উৎসাহের মাঝে সেই অপসংস্কৃতি কি পারমাণবিক ক্ষুদ্রাকৃতিতে লুকিয়ে আছে? ভবিষ্যতে কখনো এ অপশক্তি বোমা হয়ে জন্ম নিতে পারে কি? ভাববার প্রয়োজন আছে!

ফ্যাসিবাদী আচরণ কীভাবে স্বাধীনতাযোদ্ধাদের আচরণেও প্রকাশ পেতে পারে এ প্রশ্নটা জরুরি। এ হচ্ছে অপসংস্কৃতির আত্মীকরণ। পাওলো ফ্রেইরি বলেছিলেন, “অত্যাচারিত অত্যাচারীর সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে। শোষণ ও নির্যাতন অপসংস্কৃতি রূপে মানুষের মনে ও আচরণে সম্পৃক্ত থাকে যা অদৃশ্য ও তাই চিহ্নিত করা দুরূহ। এভাবেই ঔপনিবেশিক শক্তি চলে যাওয়ার পরও স্বাধীন দেশের মানুষ ঔপনিবেশিক আচরণসমূহ ধারণ ও চর্চা কওে অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক লুণ্ঠন, শারীরিক নির্যাতন, মাৎস্যন্যায় আরও বাড়ে কেননা পরিবর্তিত নির্যাতনকারী চেহারাসুরতে নির্যাতিতের মতই, তাকে চেনা ও তা দূর করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে তাই। ইংরেজিতে যাকে বলে কলোনিয়াল হ্যাঙওভার, বাংলায় এর যুৎসই প্রতিশব্দ হতে পারে ‘ভূত’অদৃশ্যরূপে যা কাঁধে ভর করে থাকে বলে বিশ্বাস করা হয়। নির্যাতকের সকল ভূত তার পতনের পরও ঠিকই থেকে যায়। অত্যাচারী শাসকের এই ভূত কেবল তার শাসনযন্ত্রের মধ্যেই থাকে না, থাকে শাসিতের মানসেও।

অত্যাচারের সংস্কৃতি আত্মস্থ করার বিষয়ে লেনিনসহ অনেক বিপ্লবী নেতাই সতর্ক করেছেন। বিংশ শতাব্দীর আরেক শ্রেষ্ঠ নেতা নেলসন মান্ডেলা তার ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ বইয়ের শেষ পাতায়ও বলেছেন, “আমি খুব ভালোভাবে জানতাম যে, অত্যাচারিতের মত অত্যাচারীকেও নিশ্চিত মুক্ত করতে হবে। যে মানুষ অন্যের স্বাধীনতা হরণ করে সে ঘৃণার কারাগারে বন্দি, কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার শিকের পেছনে তার বাস। অত্যাচারিত ও অত্যাচারী উভয়ের মানবতাই লুণ্ঠিত হয়। কারণ উভয়ই একই অপসংস্কৃতির ভূত দ্বারা শাসিত, যা তাড়ানো খুবই কঠিন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভূতপূর্ব বিজয়ের পর দেশে এমন কিছু ঘটেছে ও ভবিষ্যতে আরও ঘটতে পারে যা এ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে ও আরও করতে পারে। কারণ পরাজিত শক্তির ভূত গোপনে তার কাজ সিদ্ধ করে যাচ্ছে। পরাজিত শক্তি দেশে জ্ঞানের চর্চাকে বাড়ানোর জন্য কিছু করেনি, বরং নানাবিধ কৌশলে তা সংকুচিত করেছে। বই পড়ার অভ্যাস আগেও কম ছিল, এখন তা আরও কমেছে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কঠিন কাজ মানুষের মনে বইপ্রেম তৈরি করা। সে কাজটি অবহেলা করে বই পোড়ানোর উৎসব শুরু করে দিলে বইপ্রেম উধাও হয়ে যেতে আর সময় লাগবে না।

তবে গত পনের-ষোলো বছরে বইয়ের নামে যেসব আবর্জনা তৈরি হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সস্তায় খুশি করে সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার ধান্দাবাজি থেকে সরকারি অর্থ অপচয় করে যা দিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থাগার ভরে তুলে মানুষকে আরও বইবিমুখ করে তোলা হয়েছে, সেগুলো তাদের উপযুক্ত জায়গাতেই ফেলা যেতে পারে। কিন্তু কোনোটাই পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণ ও অপচয় আরও বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। এচর্চা আমাদেরকে আরও পিছিয়ে দেবে, যা হবে বর্তমান এ বিজয়ের ব্যর্থতার পরিচায়ক।

শেষ পাতায় মান্ডেলার কথাকে সামান্য পরিবর্তন করে বলা যায়, এ আন্দোলনের বিজয় মূলত বাংলাদেশ থেকে সকল বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করার স্বাধীনতা। তেমন কিছু সমাধান হয়নি, সমাধানের লক্ষ্যে কাজের জন্য মুক্তি অর্জন করেছি মাত্র। বইটিতে মান্ডেলার শেষ কথাগুলো তাই: স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ব আসে। তাই আমি আর বসে থেকে দেরি করতে পারছি না, কেননা আমার দীর্ঘ পথ হাঁটা এখনও শেষ হয়নি।

কারো বই পুড়িয়ে এক পাও আগানো যাবে না। বরং অনেক জটিল ও কঠিন কাজ পড়ে আছে সামনে, চটকদার কাজের বদলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমরেডদের সেসব কাজে মন দিতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version