-->
শিরোনাম

রাজপথ এখন দাবি আদায়ের কেন্দ্রস্থল

সৌমেন্দ্র গোস্বামী
রাজপথ এখন দাবি আদায়ের কেন্দ্রস্থল

ঢাকার নামকরণ নিয়ে নানা প্রবাদ তথা গল্প প্রচলিত আছে। তবে শ্রী কেদারনাথ মজুমদার ‘ঢাকার বিবরণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রবাদ যেরূপ-ই থাকুক না কেন ঢাকা নামটি অতি প্রাচীন তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। ঢক্কা শব্দ হইতে ঢাকা শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে, ইহা অনুমিত হইতে পারে। ঢাকার নাম “আইন-ই-আকবরী” গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায়। উক্ত গ্রন্থে ঢাকাবাজু নামে যে পরগণার নাম লিখিত হইয়াছে, তাহা হইতেই ঢাকা শব্দের উৎপত্তি হইয়াছে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে টোডরমল্ল ঢাকাবাজুর (পরগণার) বন্দোবস্ত করেন; তৎকালে বুড়িগঙ্গার উত্তর তীরভূমি ঢাকাবাজু নামে পরিচিত থাকিয়া তাহ সরকার বাজুহার অন্তর্গত ছিল। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে নবাব ইসলাম খাঁ এই ঢাকাবাজুতে আসিয়া স্বীয় রাজধানী স্থাপন করেন ও পরগণার বা বাজুর নামানুসারে রাজধানীর নাম প্রদান করেন। তদবধি এই স্থান ঢাকা নামে পরিচিত।’

একইভাবে ঢাকার গেণ্ডারিয়া, মহাখালী, মাহুতটুলী, পিলখানা, এলিফ্যান্ট রোড, ইন্দিরা রোড, কাকরাইল, রমনা পার্ক, গোপীবাগ, পরীবাগ, ফার্মগেট, বকশীবাজার—ঢাকার এ স্থানগুলো নানা কারণে সমৃদ্ধ, ইতিহাস–ঐতিহ্যের অংশ। এসব স্থানের নামকরণের পেছনেও আছে ইতিহাস। এই যেমন পিলখানা থেকে হাতির দলকে হাতির ঝিলে নিয়ে যাওয়া হতো। হাতির ঝিলের জলে ভিজে হাতিরা মাহুতের দেখানো পথে রমনা পার্কে যেত রোদ পোহাতে। একই পথে বেলা ফুরোনোর আগেই ফিরত পিলখানায়। এলিফ্যান্ট রোড নামের পেছনে আছে এমনই ইতিহাস।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মোট বাসিন্দা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন।বিস্মিত হতে হয়, কী বিশাল জনগোষ্ঠীর শহর ঢাকা! কত আনন্দবেদনার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ দিন অতিবাহিত করে। নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় আছে, ‘শহর জেগেছে, দূরে ঘণ্টায় প্রাণের ধ্বনি,/ রোগীর শরীরে নামলো নিদ্রা হাসপাতালে,/ যারা কোনো দিন ভুলেও পেলো না আপন জন,/ ছেঁড়াখোঁড়া সেই ক’জন রাতের জুয়োশেষের/ ক্লান্তিতে ফের ভিড়লো ধোঁয়াটে রেস্তোরাঁয়।’

কবিতায়, গানে, গল্পে, চলচ্চিত্রে ঢাকা শহর হয়ে উঠেছে প্রেমের, দ্রোহের ও স্বপ্নের নগরী। চলচ্চিত্রে গ্রাম থেকে প্রথমবার ঢাকা শহরে আসা চরিত্রের মুখে শোনা যায়, ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে/ আরে লাল লাল, নীল নীল বাত্তি দেইখা নয়ন জুড়াইছে।’ ঢাকা শহরকে নিয়ে আক্ষেপের কথাও লেখা হয়েছে অনেক। ‘এখন আমার কাছে এ শহর বড় বেশি ধূসর/ ধূসর বলে মনে হয়।’ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ঢাকা শহরকে নিয়ে তাঁর জীবনের বেদনা, স্বপ্ন ও ভালোবাসার কথার দলিল ‘আমার শহর’ শিরোনামের দীর্ঘ কবিতাটি শুরু করেছেন পঙ্ক্তি দুটি দিয়ে।

ভালোবাসার পাশাপাশি ঢাকার প্রতি অভিমানও আছে অনেকের। তাঁদের, যাঁদের কাছ থেকে এই শহর কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছ্।ু যাঁরা ঢাকায় এসে হারিয়েছেন সর্বস্ব। তা ছাড়া ট্রাফিক জ্যামের মতো নানা সমস্যা লুকিয়ে আছে শহরের রন্ধে রন্ধে। কখনো কখনো অধৈর্য হয়ে কবির মতো অনেকেরই তাই বলতে ইচ্ছা করে, ‘কোনখানে?/ এ আমি কোথায়?/ এ কোন শহরে? প্রতিদিন করে যাচ্ছি সমূহ রোপণ।’

দৃষ্টান্তটি নাটকের হলেও বাস্তবিকভাবেও এটি সত্য। যেকোনো দাবি পূরণের জন্য মানুষকে ঢাকায় আসতে হয়। সম্প্রতি একসঙ্গে বিভিন্ন দাবি নিয়ে নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ রাজপথে নেমেছেন। দূরদূরান্ত থেকে এসেও যুক্ত হয়েছেন অনেকে। চাকরি স্থায়ীকরণ, দুর্নীতি রোধ, এইচএসসি পরীক্ষা ইত্যাদি দাবি তাদের। ঢাকার রাজপথ হয়ে উঠেছে দাবি আদায়ের কেন্দ্রস্থল। ঢাকা যেন আজ দাবির শহর!

সমস্যা, সীমাবদ্ধতা, আক্ষেপের পরেও ভালোবেসে আহ্লাদ করে ঢাকাকে কেউ মায়ার শহর, জাদুর শহরসহ প্রভৃতি নামে ডাকেন। ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা থেকে আলাদা আলাদা হলেও সবার কাছে দাবির শহর ঢাকা।কিছুদিন আগে দেখা মঞ্চনাটকের একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে, যেখানে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে বাবার কাছে জিজ্ঞাসা করতে দেখা যায়, ‘বাবা, যেকোনো দাবি পূরণের জন্যেই কি ঢাকা যেতে হয়?’ ঘুরিয়েপেঁচিয়ে বাবা যদিও ছেলেকে একটা বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে দাবি আর স্বপ্ন নিয়েই দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকা শহরে মানুষ পাড়ি জমান।

কথা হচ্ছিল একজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে। তাঁর গ্রামের বাড়ি যশোরের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মা আছেন বাড়িতে। সহজে কাজ পাওয়া যাবে, পরিবারকে ভালো রাখতে পারবেন—এ আশা নিয়েই ঢাকা শহরে এসেছিলেন তিনি। পাঁচ বছর আগে। ‘ঢাকায় কাজ পাওয়া কি সহজ?’ জিজ্ঞাসা করলে বললেন, ‘সহজই তো। এই দ্যাখেন রিকশা চালায়ে তো দিব্যি চলে যাচ্ছে। বাড়ি থাকলে এক দিন কাজ থাকত, তো পরের দিন কজ্জ করে সংসার চালাতে হতো।’ ঢাকা শহরে আসা বেশির ভাগ মানুষের গল্প এমনই। কেউ জীবিকার তাগিদে তো কেউ স্বপ্ন পূরণের জন্য এসেছেন ঢাকায়।অহর্নিশ ঢাকার যে প্রাণচাঞ্চল্য, কর্মমুখরতা, তার কিছুটা কি শব্দে শব্দে, কলরবে–কলতানে উচ্চারিত নানা দাবির ভেতরে নিহিত আছে?

শুরুতে উল্লিখিত মঞ্চনাটকটির কাহিনি সংক্ষেপ ছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দাবি আদায় করতে চান। যে কারণে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিনিধিরা ঢাকার রাজপথে দাবি আদায়ের আন্দোলনে শামিল হবেন। বাবাও চাকরি করেন ওই অফিসে। প্রতিনিধি হিসেবে যেতে হবে তাকে। এ প্রসঙ্গেই বাবার কাছে প্রশ্নটি সে করেছিল।

দৃষ্টান্তটি নাটকের হলেও বাস্তবিকভাবেও এটি সত্য। যেকোনো দাবি পূরণের জন্য মানুষকে ঢাকায় আসতে হয়। সম্প্রতি একসঙ্গে বিভিন্ন দাবি নিয়ে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ রাজপথে নেমেছেন। দূরদূরান্ত থেকে এসেও যুক্ত হয়েছেন অনেকে। চাকরি স্থায়ীকরণ, দুর্নীতি রোধ, এইচএসসি পরীক্ষা ইত্যাদি দাবি তাদের। ঢাকার রাজপথ হয়ে উঠেছে দাবি আদায়ের কেন্দ্রস্থল। ঢাকা যেন আজ দাবির শহর!

লেখক : কবি ও লেখক

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version