-->
শিরোনাম

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাই হোক প্রধানতম অগ্রাধিকার

ড. আতিউর রহমান
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাই হোক প্রধানতম অগ্রাধিকার

গত কয়েকটি সপ্তাহে বাংলাদেশের গোটা সমাজের ওপর দিয়ে একটি ঝড় বয়ে গেছে। মূলত এ দেশের তরুণ সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা থেকেই গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর একটি উদ্যোগ শুরু হতে দেখছি। নতুন এই অভিযাত্রাকে দেশের বেশির ভাগ মানুষই স্বাগত জানিয়েছেন। তবে একজন পেশাদার অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নির্মোহ মূল্যায়নও জরুরি বলে মনে করি।

গেল এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশব্যাপী যে উথাল-পাথাল হয়েছে তার প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছে অর্থনীতির ওপরও। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা, বন্দর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়া, মিল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, পরিবহন ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটাসহ আরও নানা কারণে আমাদের সাপ্লাই চেইনগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। টাকার মানের ব্যাপক অবমূল্যায়ন ও জ্বালানির উচ্চ দামের কারণে আমদানিবাহিত উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ তো আগে থেকেই ছিল। নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ্য অর্থনীতিবিদদের উপস্থিতি আমাদের সবাইকে আশাবাদী করছে। তবে বড় পরিবর্তনের পরবর্তী অর্থনৈতিক অস্থিরতাগুলো এখনো যে বিরাজমান সেটা অস্বীকার করা যাবে না।

সব অংশীজনই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করছেন। সেটিই কাম্য। তবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য ‘বিজনেস কনফিডেন্স’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সামাজিক সুস্থিতি এজন্য খুবই জরুরি। নতুন বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান উপদেষ্টাসহ আরও একাধিক প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদকে নীতিনির্ধারক হিসেবে পাওয়ায় আমরা অনেকটা ভরসা পাচ্ছি। শুরুতেই তাদের পক্ষ থেকে যে নীতি-নির্দেশনাগুলো আসছে সেগুলোকে সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখীই মনে হচ্ছে। এক বছর ধরেই আমরা বারবার বলে আসছি যে, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জিং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। এজন্য সরকারি ব্যয়ে প্রয়োজনীয় কাটছাঁট করার পরামর্শও বারবার দিয়েছি। একই সঙ্গে কর্মক্ষম তরুণদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার কথাও বলেছি।

আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির নিজস্ব শক্তি তথা ‘রেজিলিয়েন্সে’র বিষয়েও আত্মবিশ্বাসী থাকতে হবে। আমরা বরাবরই বলে এসেছি যে, ঋণ-জিডিপির অনুপাতের বিচারে বাংলাদেশ একটি নিরাপদ অবস্থানেই রয়েছে। বিদেশি ঋণের দায় শোধে আমাদের প্রশংসনীয় ট্র্যাক রেকর্ডও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ ঋণ পাওয়া বা না পাওয়া নয়, বরং ঋণের অর্থ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সেটিই দেখার বিষয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবিত হওয়ার পরও আমরা বলেছি, ঋণ-সহায়তার সুদক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করাই বাজেট বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টার মুখেও একই কথা প্রতিধ্বনিত হতে দেখে তাই আশ্বস্ত হয়েছি। পাশাপাশি তিনি সরকারি ব্যয় যৌক্তিকীকরণের কথাও বলেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখা ও মানুষের জীবিকা উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রকল্প ও কর্মসূচিগুলো চালু রাখার পক্ষে বললেও এসব ক্ষেত্রে অপচয় রোধের সর্বাত্মক উদ্যোগের কথা বলেছেন তিনি। পরিকল্পনা উপদেষ্টারও একই মত। আসলেই যদি অপচয় না করে সম্পদগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তা হলে এই সংকট উত্তরণ খুবই সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নরের বক্তব্যগুলো আমাদের বড় আশা দেখাচ্ছে। তিনি একজন পেশাদার অর্থনীতিবিদ হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন এবং অনেক বছর ধরে দেশের অর্থনীতি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণী চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তার কাজ ও লেখালেখির মাধ্যমে। আমি নিজেও তার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে জানি যে, তিনি একজন বাস্তববাদী অর্থনীতিবিদ। তা ছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকের মতো সফল একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবেও খুব কাছে থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী শক্তি ও উদ্যম তিনি দেখেছেন। আমরা দীর্ঘকাল ধরেই মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে চাঙ্গা করার কথা বলে আসছি। নতুন গভর্নর এই বাজারকে চাঙ্গা করতে ২.৫ শতাংশের ব্যান্ড বা মার্জিনের যে নীতি-প্রস্তাবনা রেখেছেন তা খুবই বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী বলে মনে করি (আগে ১ শতাংশ ছিল)।

এ ছাড়া এ মুহূর্তে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিদ্যমান কোনো প্রণোদনা প্রত্যাহার না করার যে সিদ্ধান্তের কথা শোনা যাচ্ছে সেটিকেও যথোপযুক্ত বলতে হয়। এ ছাড়া ওয়েজ আর্নার বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক কোটি টাকার যে সীমা দেওয়া ছিল সেটিও হয়তো দ্রুতই তুলে নেওয়া হবে। তা হলে প্রচলিত কম টিকিটের প্রবাসী আয়ের সঙ্গে বড় টিকিটের দীর্ঘমেয়াদি প্রবাসী আয় দেশে প্রবেশ করবে। আর কে না জানে যে, বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ প্রবাসী আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক ভোগ ও বিনিয়োগ ছাড়াও সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় এই প্রবাস আয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে! আশার কথা, কয়েকদিন ধরে প্রবাসী আয়ের পালে হাওয়া লেগেছে। আনুষ্ঠানিক পথে ফের তার প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। অবশ্য টাকা-ডলার বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখার কারণে এই প্রবাহের গতি বেড়েছে।

এ ছাড়া নতুন গভর্নর চলমান সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে আরও কিছুদিন সঙ্কোচনমূলকই রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে নতুন গভর্নর তাড়াহুড়ো না করে, জনতুষ্টিবাদের পথে না এগিয়ে বাস্তবমুখী সুবিবেচনাপ্রসূত নীতিই অনুসরণ করবেন। সেটিই কাম্য। তবে যে কথাটি সবাইকেই মনে রাখতে হবে তা হলো আমরা এখন ভীষণ অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তাই নীতিনির্ধারকদের ওপর কোনো অযৌক্তিক আকাক্সক্ষার চাপ তৈরি করা উচিত হবে না। বরং ‘রয়েসয়ে এগোনো’র নীতিকেই সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে। নীতিনির্ধাককদেরও জনতুষ্টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিবর্তে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই যে জরুরি- সে বার্তাটি বারবার দিতে হবে।

এ ক্ষেত্রে যে বিষয় বা পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করতে হবে তা হলো-

১. সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করার যে অভিপ্রায় পরিকল্পনা উপদেষ্টা প্রকাশ করেছেন তা বাস্তবায়ন করা জরুরি। তবে তা যেন কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহায়ক উদ্যোগগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে সেদিকে নজর রাখা চাই। ছোট-বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে কোনগুলো কীভাবে অর্থায়ন করা হবে তার অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। এজন্য প্রয়োজনে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি মনিটরিং ও পর্যালোচনা কমিটিও করা যেতে পারে।

২. সামাজিক খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায়) বাজেট বরাদ্দ নিয়ে নতুন করে ভাবা চাই। এই দুর্যোগের সময়ে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ ছাড়া প্রান্তিক ও বিপন্ন মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে বন্যার্ত মানুষগুলোর জন্য দ্রুত ত্রাণ ও সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়ার দরকার রয়েছে।

৩. মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাজারভিত্তিক নীতি অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে। আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারকে চাঙ্গা রাখার জন্য সব অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে সতর্ক নজরদারি বহাল রাখা চাই। ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করার যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন গভর্নর তা অব্যাহত থাকুক। মুদ্রানীতিতে বাজারভিত্তিক নীতি সচল থাকুক।

৪. প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেগবান রাখতে হবে। দরকারবোধে নতুন নতুন প্রণোদনা দিয়ে এ প্রবাহ কী করে আরও বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দেওয়া চাই।

৫. সবশেষে এ কথাটি মনে রাখতেই হবে যে, কৃষিই আমাদের অর্থনীতির প্রাণভ্রমরা। তাকে সুরক্ষা দিয়ে যেতেই হবে।

তাছাড়া ভালো মুনাফায় অফশোর ব্যাংকিং আমানতের যে সুবিধা চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা যেন অব্যাহত থাকে। কেননা এই সময়টায় আনুষ্ঠানিক পথে আরও বেশি করে প্রবাস থেকে বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version