-->
শিরোনাম

সংবিধান পুনর্লিখন: ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ

আমীন আল রশীদ
সংবিধান পুনর্লিখন: ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা ফোরাম থেকে সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি উঠছে। গত ২৯ অগাস্ট রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএসের একটি সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিসটিংগুইশ অধ্যাপক আলী রীয়াজও এই মত দিয়ে বলেছেন, সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার অসম্ভব। তার মতে, বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার সহায়ক। ফলে এর কিছু ধারা সংশোধন করেও এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে। আর সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে গণপরিষদ নির্বাচন দেওয়া। গণপরিষদ নতুন করে সংবিধান তৈরির পরে ওই সংবিধানের আলোকে হবে পরবর্তী জাতীয় সরকার নির্বাচন।

১. সংবিধান পুনর্লিখনের উদ্যোগ নিলে তার সাংবিধানিক ঝুঁকি কী? ২. আগে নির্বাচন তারপরে সংবিধান পুনর্লিখন নাকি সংবিধান পুনর্লিখনের পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন? ৩. সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কিনা? ৪. সংবিধান পুনর্লিখন করতে হলে বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করতে হবে। সুতরাং সংবিধান বাতিল করার মতো পরিস্থিতি দেশে তৈরি হয়েছে কিনা ? ৫. বিদ্যমান সংবিধানের যে এক-তৃতীয়াংশ ‘সংশোধন অযোগ্য’ সেগুলো সংশোধনের উপায় কী ? ৬. সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ গঠন ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কিনা ? একে একে প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা যাক। ১. বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ৭ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা সেটি করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তার এই কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবেন। আর এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে (মৃত্যুদণ্ড) দণ্ডিত হবেন।

প্রশ্ন হলো, যারা এখন সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি তুলছেন বা যারা মনে করেন যে বিদ্যমান সংবিধান রেখে কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কার করা সম্ভব নয়, তাদের এই বক্তব্য কিংবা যদি কেউ সংবিধান পুনর্লিখনের উদ্যোগ নেন, সেটি কি এই অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে? সুতরাং এটি একটি সাংবিধানিক ঝুঁকি। বস্তুত সংবিধানের এই বিধানটি যুক্ত করা হয় ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। উদ্দেশ্য ছিল, বন্দুকের নলের মুখে কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করে যাতে সংবিধান স্থগিত করতে না পারেন। কিন্তু কেউ যদি বিদ্যমান সংবিধান স্থগিত, বাতিল কিংবা পুনর্লিখনের উদ্যোগ নেন, সেটি এই অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে কিনা ?

২. সংবিধানের ৭ (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে। তার মানে ৫০টিরও বেশি অনুচ্ছেদকে সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। যেসব অনুচ্ছেদকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে জাতির পিতার প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন, রাষ্ট্রধর্ম, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মালিকানার নীতি, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, সুযোগের সমতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের সংবিধানে মোট অনুচ্ছেদ ১৫৩টি। এর মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করাটা কতটা যৌক্তিক— তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও রাষ্ট্রদ্রোহিতা কিনা, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

৩. যারা সংবিধান পুনর্লিখন জরুরি বলে মনে করেন তাদের যুক্তি হলো, জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানের সূচনা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে হলেও এর অন্তর্নিহিত দাবি ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। অর্থাৎ যে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্র কাঠামোর কারণে নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ভেঙে গিয়েছিল; গণতন্ত্র, নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল; দলীয়করণের ফলে সকল প্রতিষ্ঠান ভেঙে গিয়েছিল; অবকাঠামো খাতে অনেক উন্নয়ন হলেও সেই উন্নয়নের বিপরীতে দুর্নীতি ও অনিয়ম সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল— সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ এবং সর্বোপরি একটি বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠন ছিল এই আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি। সুতরাং তারা মনে করেন বিদ্যমান সংবিধান রেখে এই অবস্থা থেকে রাষ্ট্রকে একটি নতুন ধারায় পরিচালিত করা সম্ভব নয়। ওই কারণেই তারা মনে করেন আগে গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে, যে নির্বাচনে বিজয়ীরা সংবিধান পুনর্লিখন করবেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়, তার কারণ মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনটি ছিল গণপরিষদ গঠন করে সংবিধান প্রণয়নের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে ওই নির্বাচনে বিজয়ীরা পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করতেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান অংশ থেকে বিজয়ীরাই গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশের জন্য সংবিধান রচনা করেন এবং এরপর গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ।

৪. গত জুলাই-অগাস্ট মাসে একটি অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারের পতন হয়েছে এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও পালিয়ে গেছেন। ওই ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে এমন একটি অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত হয়েছে, যারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নয়। এই সরকার বা জনগণেরও বিরাট একটা অংশ মনে করছে যে, তিন মাসের মধ্যে একটি নির্বাচন দিয়ে একটি নতুন সরকার গঠনে সহায়তা করাও এই সরকারের মূল এজেন্ডা নয়— ফলে এমন একটি ব্যবস্থার দিকে তাদের যেতে হবে, যাতে করে ৫ অগাস্ট পূর্ববর্তী রাষ্ট্র ও সরকার কাঠামোয় ফিরে নতুন করে আরেক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হতে না পারে। সেজন্য বিদ্যমান সংবিধানের অনেকগুলো ধারা শুধু সংশোধন নয়, বরং বাতিল করতে হবে। আর ওই কারণেই সংবিধান পুনর্লিখনের বিষয়টি সামনে আসছে।

সংবিধান গবেষক আরিফ খানের প্রশ্ন, গণপরিষদ গঠনের জন্য যে ধরনের বিপ্লব বা অভ্যুত্থান হয়, জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থান কি সেরকম ছিল? এই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য কি সংবিধান রচনা? তিনি মনে করেন, এই অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন। সেটি বৈষম্যহীন সমাজ ১৯৭২ সালের সংবিধান মেনেই গঠন করা যায়। কিন্তু কোনো সরকার সেটি করেনি। আরিফ খানকে প্রশ্ন করেছিলাম, অন্তর্র্বতী সরকার কি গণপরিষদ নির্বাচন দিতে পারে বা এই এখতিয়ার কি তার আছে? তিনি বলেন, প্রশ্নটা জটিল। কেননা যদি এই সরকার সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দিতে চায়, তাহলে আগে বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করতে হবে। কিন্তু সংবিধান বাতিলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কিনা? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, দেশের মানুষ মনে করে কিনা যে, বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান লিখতে হবে? এ বিষয়ে জনগণের মতামত নেওয়া হবে কিনা? হলে সেটি কোন পদ্ধতিতে?

৫. আগে গণপরিষদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলে ওই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে যারা গত ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে, তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? মাঠের রাজনীতিতে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এরই মধ্যে বলেছে যে, তারাও নির্বাচনের আগে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য অন্তর্র্বতী সরকারকে সময় দিতে চায়। কিন্তু সেটি অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়। আবার অন্তর্বর্তী সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকতে চায়, ওই বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা না এলেও গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, নির্বাচন কবে হবে সেটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন নিয়ে যদি আগামী ৬ মাসের মধ্যে বিএনপি এবং অপরাপর দলগুলো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে, তাহলে কি সরকার ওই চাপের মুখে নির্বাচনের আয়োজন করবে? যদি এই চাপ তারা মেনে না নেয় তাহলে তাদের সঙ্গে কি সরকারের বিরোধ তৈরি হবে? দ্বিতীয়ত, সরকার যদি সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য আগে গণপরিষদ নির্বাচন দিতে চায়, সেটিও কি রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে? যদি মেনে না নেয় তাহলে অন্তর্র্বতী সরকার এবং তাদের পেছনে মূল যে শক্তি ছাত্র-জনতা— তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে?

৬. সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ গঠন ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কিনা? আছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হবে যদি তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে তাহলে তারা সংবিধান পুনর্লিখন করতে পারবে। সেক্ষেত্রে তাদের প্রথম সংশোধনী এনে ৭ (ক) এবং ৭ (খ) অনুচ্ছেদ দুটি বাতিল করতে হবে। এরপর অন্যান্য অনুচ্ছেদ সংশোধন বা পুনর্লিখন করতে হবে। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে বিরোধীদের সম্মতি নিয়ে এই প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে। তার মানে সংবিধান পুনর্লিখন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচনের ইস্যুটি নিয়ে আগামী দিনের রাজনীতিতে আরও অনেক বেশি কথা হবে, আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হবে, সেটি বোঝা যাচ্ছে।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version