-->
শিরোনাম

সীমান্তে হত্যা : দায় আছে আমাদেরও

সিরাজুল ইসলাম
সীমান্তে হত্যা : দায় আছে আমাদেরও

ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতীম ও নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। কিন্তু বন্ধুপ্রতীম এই দুই দেশের মাঝে ক্ষত হয়ে দেখা দিয়েছে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড। নিয়মিত বিরতিতেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। বিভিন্ন সময় দুই দেশের উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরাও। এ কারণে সীমান্তের মানুষ আতঙ্কে থাকেন। সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় নিয়মিত চাষাবাদ করতে পারেন না অনেকে। বিএসএফ মারধর করে, অনেক সময় ধরে নিয়ে যায়।

সীমান্ত হত্যা নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ৯ বছরে বিএসএফের হাতে ২৪৫ জন বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তবে একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতাই সীমান্ত হত্যাকাণ্ডকে উসকে দিচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডের দায় আমরাও কিন্তু এড়াতে পারি না। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তো অবশ্যই এই দায় এড়াতে পারেন না। দায় আছে জনপ্রতিনিধিদেরও। অবশ্য এই লেখাটি যখন লেখা হচ্ছে, তখন মেম্বার ও কাউন্সিলর ছাড়া জনপ্রতিনিধি বলে কেউ নেই। যাই হোক, সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন যারা, তাদের বেশিরভাগকে চোরাকারবারি বলা হচ্ছে। এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও এই তথ্য দিচ্ছেন। তার মানে হলো, কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে বাংলাদেশের মানুষ ভারতে প্রবেশ করে কিংবা করার চেষ্টা করে। ওই সময় গুলি চালায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। অনেকে গুলিতে নিহত হন, আহত হন। লাশ পড়ে থাকে বাংলাদেশের ভেতরে। অনেক সময় গুলিতে আহত ব্যক্তিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তার সঙ্গীরা। তাদের চিকিৎসা হয় গোপনে। কখনো কখনো আহত ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায় বিএসএফ। কেউ ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফেরেন, কেউ ওদেশেই মারা যান।

শেখ হাসিনা সরকারের বিদায় এবং অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও সীমান্ত হত্যাকাণ্ড থামেনি। ২৯ অগাস্টের হিন্দুস্তান টাইমস জানাচ্ছে, গভীর রাতে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা, উত্তর দিনাজপুরের সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে এক বাংলাদেশি। পত্রিকাটির খবরে জানা যায়, হেমতাবাদের চৈনগর সংলগ্ন সীমান্তে গভীর রাতে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীরা প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। তখনই তাদের বাধা দেয় বিএসএফ। বাধা অগ্রাহ্য করে তারা এগোতে থাকলেই, বিএসএফ গুলি চালায়। তাতেই মৃত্যু হয় একজনের। এর আগে ১৮ আগস্ট কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে বিএসএফের হাতে ৫ বাংলাদেশি আটক হয়েছে বলে একটি খবর প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের দৈনিক ইত্তেফাকে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে আন্তর্জাতিক স্থল সীমান্ত রয়েছে; যা বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন। এরপর আমরা ধরে নিয়ে ছিলাম, সীমান্তে আর হত্যাকাণ্ড ঘটবে না। তবে ওই আশার গুড়ে বালি পড়তে সময় লাগেনি। প্রতিবছরই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সীমান্ত সম্মেলন হয়। এবারও হয়েছে।

গত ৯ মার্চ ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলনের শেষদিন বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালকের যৌথ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। বিএসএফ মহাপরিচালক নিতিন আগারওয়াল তখন বলেছিলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ প্রাণঘাতী নয়— এমন অস্ত্র ব্যবহার করছে। সীমান্তহত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা আশাবাদী হলাম। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই সেই আশা ফিকে হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হলো, প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্রই যদি ব্যবহার করা হয় তাহলে মানুষ মরছে কেন? আমাদের দেশেও তো রায়ট নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাবার বুলেট ছোড়ে। মানুষ আহত হয়, কিন্তু প্রাণে মরে না। তাহলে আপনাদের বুলেটে মরছে কেন? আসলে আপনারা কথা দিয়ে কথা রাখছেন না। মানুষ হত্যা করছেন। আসা যাক দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কথায়। তিনি সরকারপ্রধান, সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তার কথাও কি বিএসএফ শুনছে না? নাকি তিনি মুখে বলেছেন গুলি চলবে না, আর ইশারায় বলেছেন ‘ওপেন ফায়ার’।

এবার নজর দেওয়া যাক আমাদের দায় সম্পর্কে। চোরাকারবারি কারা, ওই খবর কি আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী জানে না? তাদের কাছে কি তালিকা নেই? এসব প্রশ্ন কিন্তু সামনে চলে এসেছে। সীমান্ত পার হয়ে এদেশের নাগরিক ভারতে ঢুকে পড়ল আর বিএসএফ সেটা টের পেয়ে গুলি চালাল। অথচ বিজিবি কিছুই জানল না! এরকম তো হতে পারে না। আমাদের সীমান্তরক্ষীরা যদি ভারতে প্রবেশের আগেই এই লোকগুলোকে ফিরিয়ে দিত, তাহলে হয়তো কারও প্রাণ যেত না। যদি চোরাকারবারিরা বারবার বাধাপ্রাপ্ত হতো, তাহলে তারা ব্যবসা ছেড়ে দিত। বাধা না পাওয়ার কারণেই তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

মজুর শ্রেণির লোককে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার উৎসাহ জোগাচ্ছেন মাফিয়ারা। বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। পথে বসছে পরিবার। আর চোরাকারবার করে লাভবান হচ্ছেন মাফিয়ারা। এ থেকে এটাই বলা যায়, বিজিবি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। চোরাকারবারিরা বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিতে পারছে না কিন্তু বিজিবির চোখ ঠিকই ফাঁকি দিচ্ছে! এর মানে হলো ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। এবার আসি পুলিশ ও জনপ্রতিনিধি প্রসঙ্গে। আমাদের পুলিশ বাহিনী অনেক দক্ষ, সাহসী। তারা কেন জানতে পারছে না চোরাকারবারিদের নাম? তাদের কেন জেলে ঢোকানোর ব্যবস্থা তারা করছে না? নাকি ‘টু পাইস’ নিয়ে তারা চুপ আর প্রাণ হারাচ্ছেন মজুর শ্রেণির চোরাকারবারিরা। এর দায় কিন্তু পুলিশ এড়াতে পারে না।

অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিরা কেন চোরাকারবারিদের তালিকা করে পুলিশ কিংবা বিজিবিকে দিচ্ছেন না? একজন চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বারের পক্ষে তো তার এলাকার দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসী, মাদক বিক্রেতা ও চোরাকারবারির নাম অজানা থাকার কথা নয়।

সব মিলিয়ে আমরাও সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারি না। আরেকটি কথা না বললেই নয় বিএসএফ শুধু বাংলাদেশিদেরই হত্যা করে; ভারতীয়দের হত্যা করে না। চোরাচালান একটা চেইন। এখানে ভারতীয়রাও জড়িত। অথচ খেয়াল করলে দেখবেন, আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির হাতে কখনো ভারতীয় নাগরিকরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন না। এই প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ভারতের সদিচ্ছার অভাবেই সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতন কমছে না। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে কিন্তু কখনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কিংবা সাধারণ ভারতীয়রা নির্যাতিত হয় না; হত্যার শিকার হয় না। বরং বিএসএফ দ্বারাই বাংলাদেশের মানুষ হত্যার শিকার হয়, নির্যাতিত হয়। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দুর্বল। তাই আমরা ভারতকে এই হত্যা বা নির্যাতন বন্ধে কঠোর বার্তা দিতে পারছি না। তিনি বলেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশকেও আরও সতর্ক হতে হবে। দেশে চোরাচালান ও মাদক পাচার বন্ধে কঠোর হতে হবে। কিছুদিন আগে বিএসএফের গুলিতে এক বিজিবি সদস্য নিহতের ঘটনায় সরকারের কঠোর ভূমিকা দরকার ছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই চোরাকারবারিরা সকলকে গোপনে ম্যানেজ করে অবৈধভাবে আসা-যাওয়া করে। তবে মাঝে-মধ্যে যখন সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা থাকে, তখন কাউকে দেখামাত্রই গুলি ছোড়ে বিএসএফ। অনেক সময় গুলি করে মানুষ হত্যা করে লাশও নিয়ে যায়। তবে প্রতিটি সীমান্ত এলাকাতেই রয়েছে দালালচক্র। তাদের নিয়ন্ত্রণে সীমান্তে চলে সকল অপকর্ম।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, গত বছর সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন ২৮ বাংলাদেশি। এর মধ্যে খুলনায় ৬ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, সিলেটে ৪ জন এবং রংপুরে ১৩ জন। সীমান্তে হত্যার পাশাপাশি নারকীয় নির্যাতনের কথাও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সময় ঘটেছে।

২০১৪ সালে ভারত থেকে গরু রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপরও চোরাইপথে গরু আসছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন মূলত রাখাল শ্রেণির চোরাকারবারিরা। ২০১১ সালে সীমান্তে ফেলানি হত্যার নির্মম ঘটনা বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে। এর বছর ছয়েক পরে ২০১৮ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। ওই প্রতিশ্রুতি তারা রাখেনি।

২০১৫-২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে আসকের হিসাবে ২৪৫ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৪৬ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ জন, ২০২০ সালে ৪৯ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২২ সালে ২৩ জন এবং ২০২৩ সালে ৩০ জন। আর সর্বশেষ চলতি বছরে প্রথম সীমান্ত হত্যার শিকার হন বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য। এমনকি বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর মাসেই চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেট সীমান্তে ৭ বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন জানান, যদি আমরা ধরেও নেই সীমান্ত দিয়ে পাচার হচ্ছে, চোরাচালান হচ্ছে, কিন্তু সেটারও তো একটা আইন আছে, বিচারের আওতায় না এনে তো একটা মানুষকে মারা যাবে না। সীমান্তে হত্যার বিষয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের কোনো বিষয় বা ঘাটতির কোনো বিষয় নেই। বিএসএফের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরাল পদক্ষেপ দরকার। ওই বিষয়ে আমাদের দেশের তরফ থেকে তাদের তাগিদ দিতে হবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মনে করেন, এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তৎপর হতে হবে। সীমান্তে হত্যা বন্ধে সংশ্লিষ্ট এই দপ্তরগুলোতে তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে। দুই দেশেই আইন আছে, তবুও সীমান্তে আইন লঙ্ঘন করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে; যা মানবাধিকার লঙ্ঘন।

সীমান্ত হত্যার বিষয়ে আইনের প্রয়োগ যেমন দরকার, তেমনি দরকার সচেতনতা। সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিজিবি ও জনপ্রতিনিধিরা মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে পারেন। তাদের বোঝাতে হবে— দু-হাজার টাকা নয়, তোমার জীবনের দাম অনেক বেশি।

 

লেখক : সাংবাদিক

 

মন্তব্য

Beta version