বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ৫৩তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রামে পাক-হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন তিনি। এদিন পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে প্রতিরোধ এবং দলীয় সঙ্গীদের জীবন ও অস্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন নূর মোহাম্মদ শেখ। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশোরের পাকিস্তানি স্যুতিপুর ক্যাম্পের একটু দূরে গোয়ালহাটি গ্রামে টহল দিচ্ছিলেন পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জেনে তিন দিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা দমার পাত্র নন। এই দলেই ছিলেন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নান্নু মিয়া। কিন্তু প্রতিপক্ষের একটা গুলি এসে লাগে তার গায়ে। নূর তাকে এক হাত দিয়ে কাঁধে তুলে নিলেন আর অন্য হাত দিয়ে গুলি চালাতে থাকলেন। কৌশল হিসেবে বারবার তিনি অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকেন। উদ্দেশ্য ‘একজন নন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করছেন’ শত্রুদের এ রকম একটা ধারণা দেওয়া।
নূর মোহাম্মদ শেখ যখন এক হাত দিয়েই গুলি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ একটা গোলা তার পায়ে এসে লাগল। গোলার আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় তার পা। তিনি বুঝতে পারলেন মৃত্যু আসন্ন। যতক্ষণ সম্ভব গুলি চালাতে চালাতে তিনি শহীদ হলেন। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে নূর মোহাম্মদ রক্ষা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল সদর উপজেলার চণ্ডীবরপুর ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামে (বর্তমান নাম নূর মোহাম্মদ নগর) জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আমানত শেখ ও মা জেন্নাতুন্নেছা, মতান্তরে জেন্নাতা খানম। বাল্যকালেই বাবা-মাকে হারান তিনি। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। শৈশবেই বাবা-মা হারিয়ে অনেকটা সংসার বিরাগী জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন।
সংসারের প্রতি মন ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকরা তাকে ১৯৫২ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করান। স্ত্রী তোতা বিবির বয়স তখন ১২ বছর। ১৯৫৪ সালের শেষভাগে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান হাসিনা খাতুন। সংসারে অভাবের ছোঁয়া লাগায় দিশেহারা হয়ে যোগ দেন মুজাহিদ বাহিনীতে। ১৫ নভেম্বর ১৯৬৪, জন্মগ্রহণ করে তার দ্বিতীয় সন্তান শেখ মো. গোলাম মোস্তফা কামাল। কিছুদিন পরেই আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধে বিয়ে করেন মৃত শ্যালকের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসাকে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে দিনাজপুর সেক্টরে যুদ্ধরত অবস্থায় আহত হন। যুদ্ধ শেষে তিনি ‘তকমা-ই-জং’ ও ‘সিতারা-ই-হারব’ মেডেল লাভ করেন। মার্চ ১৯৭১এ তিনি ছুটি ভোগরত ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে অসুস্থ অবস্থায় চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর-এর ৪নং উইং এ নিজ কোম্পানির সঙ্গে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সেক্টর গঠন হলে তাদের ওপর ন্যস্ত হয় ৮নং সেক্টরের দায়িত্ব। তিনি নিয়োগ পান বয়রা সাব-সেক্টরে। এই সাব-সেক্টরের অধীনে গোয়ালহাটি, ছুটিপুর ঘাট, ছুটিপুর সেনাক্যাম্প, বরনী আক্রমণে অংশ নেন এবং বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বরনীতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার জীবন রক্ষা করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯, তদানিন্তন ইপিআর-এ সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। তার ই পি আর ক্রমিক নম্বর ছিল ৯৪৫৯। দীর্ঘদিন দিনাজপুর সীমান্তে চাকরি করার পরে ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই যশোর সেক্টরে বদলি হন। পরবর্তীতে ল্যান্স নায়েক পদোন্নতি পান তিনি। ১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের জন্মস্থান মহিষখোলার নাম পরিবর্তন করে ২০০৮ সালের ১৮ মার্চ নূর মোহাম্মদ নগর করা হয়। এরপর উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যায় নূর মোহাম্মদ নগর। তার স্মৃতিরক্ষার্থে নূর মোহাম্মদ নগরে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ এবং স্মৃতিস্তম্ভ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য