মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে ছিল বলেই দেশে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ছাত্রজনতার আত্মত্যাগ আর রক্তে মুক্তি পেয়েছে গণতন্ত্র। আমরা কি চাই? জনগণ কি চায়? শুরুতেই খোলা মত প্রকাশের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান জানানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শ্রদ্ধা জানাই। সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানটি তেমন করে প্রচার করা হয়নি, ধরে নেওয়া যায় প্রধান উপদেষ্টা চাননি বলেই হয়নি সেটা। সাইকোপ্যাথের মতো প্রশংসা আর স্তূতির তুবড়ি ছোটেনি সেই সভায়। সাজানো গোছানো নাটকের পরিবর্তে সাদামাটা মতবিনিময় আমার কাছে অনেক বেশি কার্যকর মনে হয়েছে। ড. ইউনুস বলেছেন যতটা সম্ভব যেন তাদের কাজের আলোচনা-সমালোচনা করা হয়। খোলা মতামত দেওয়ার পক্ষে তিনি। এমন কথা শাসকের মুখ থেকে আমাদের দেশ বা সমাজ শোনেনি বহুকাল। তাই ভালো লেগেছে।
এখন কথা হচ্ছে বাকস্বাধীনতা আর যা ইচ্ছে বলাটা কি এক? যে কোনো স্বাধীনতার অপর পৃষ্ঠায় থাকে দায়িত্ববোধ। সে বোধ কি বলে? যে যা ইচ্ছে বা যখন খুশি তার আবোল-তাবোল মতামত দিতে পারবেন? কথাগুলো বলছি এই কারণে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বেশ কয়েকটি বিষয়কে আজ প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। দেশের নাম, দেশের পতাকা আর জাতীয় সংগীত বিষয়ে গুজব ও কানকথার যেন শেষ নেই। আমরা সে দিকে মনযোগ দেব না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখা আমার সোনার বাংলা গানটি বদলানোর বিষয়ে খোলা ভিডিওতে যখন কেউ মত দেয় বা বদলানোর জন্য তাদের পরিকল্পনার কথা বলে তখন কি তা দেশ ও জাতির অর্জনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা মনে হয় না? আগেই বলেছি বহু তাজা প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে যে পরিবর্তন তার মূলে ছিল কোটা নামক বৈষম্যের অবসান। সে চাওয়া পূর্ণ হয়েছে। তারপর ছাত্র-জনতার চাওয়া এক দফা এক দাবি, সেটাও পূর্ণ হয়েছে। স্বৈরশাসক পলাতক। শাসনের যন্তর-মন্তর ঘর ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। সবকিছু বদলে গেছে। কিন্তু এই আন্দোলনের কোথাও কি এসব কথার উল্লেখ ছিল? না এসব পরিবর্তনের জন্য মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন?
আমাদের জাতীয় সংগীত নিয়ে চুলকানির আগেও দেখা গেছে। এর মূল কারণ আমাদের অজানা নয়। বাংলাদেশের ধর্মান্ধ ও মৌলবাদীগোষ্ঠী, যারা মুক্তমন ও ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাস করে না, তারা জাতীয় সংগীত ও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো নতুন রসদ পেয়েছে মাত্র, সে ব্যাপারে নিশ্চিত। মূলত এটা জাতীয় সংগীত বিরোধিতা নয়, রবীন্দ্র বিরোধিতা। ধর্মের মোড়কে সমাজকে বাঁধতে চাওয়া মানুষের সৃষ্টি করা বিতর্ক, যা শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহু আগেই। একদিকে মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রগতির আলো বন্ধ করতে চাইছে, অন্যদিকে আরো বেশি আলো নিয়ে নিজের মহিমায় ভাস্বর হচ্ছে আমাদের প্রাণের জাতীয় সংগীত। বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সেরা বাংলা গান হয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা’। শুধু আমরা নই, বিশ্ববাসীও এর স্বীকৃতি দিয়েছে। অলিম্পিকে বাজানো সব দেশের জাতীয় সংগীতের একটা র্যাকিং করা হয়েছিল, যেখানে ‘আমার সোনার বাংলা’ পৃথিবীর তাবৎ জাতীয় সংগীতকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।
আমাদের জাতীয় সংগীতের সঙ্গে বিগত ৫৩ বছরে যে আবেগ আর অনুভূতি জড়িয়ে আছে তা কি কেবলই রাজনৈতিক? আওয়ামী লীগের গান নয় এটি। আমরা সন্দেহ বিদ্বেষ বা কুৎসার ঊর্ধ্বে উঠলে কী দেডষ ? জিয়াউর রহমান থেকে খালেদা জিয়া কিংবা এরশাদ আমল সব সময়ই এই গান গীত হয়েছিল। আমাদের দেশ ও রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময় এই গান যেমন শক্তির উৎস হয়েছে, তেমনি আনন্দ বেদনায়ও পাশে দাঁড়িয়েছে এই গানটি। আবেগ আর বিবেকের সমন্বয় না ঘটলে কোনো কিছু কালজয়ী হয় না। কখন কোনো কারণে কোন গান বা কবিতা রচিত হয় সেটা সমালোচকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের তাতে কিছু আসে যায় না।
ওই যে বললাম আবেগ আর বিবেক এ দুটোই তাকে স্পর্শ করে। আমার সোনার বাংলা গানটিতে যখন বলা হয় ‘কী শোভা কী ছায়া গো কী স্নেহ কী মায়া গো/ কী আঁচল বিছায়েছে বটের মূলে নদীর কূলে কূলে’, তখন বাঙালি মাত্রই চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ‘তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’ এই কথায় একদিকে যেমন বেদনা অন্যদিকে বেদনার ভেতর থেকে শক্তি আহরণের কথা পাই আমরা এবং তা এতকাল ধরে আমাদের সে প্রত্যাশা পূর্ণ করে চলেছে।
আজ হঠাৎ করে এমন একটা অপ্রত্যাশিত অযৌক্তিক চাওয়া কিভাবে সামনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে? যে গানটি গাইতে গাইতে দেশের বাইরের বাংলাদেশিরা কেঁদে বুক ভাসায়, যে গানটি স্টেডিয়াম থেকে যেকোনো অনুষ্ঠানে তাদের বল জোগায় সে গানটি বদল করার হীন চেষ্টা কোনো ব্যক্তির চাওয়া নয়। এর পেছনে একটি অপশক্তি কাজ করছে, যা অন্তর্বর্তী সরকার বা রাষ্ট্রের শক্তিকে দুর্বল করতে চায়। মনে রাখতে হবে যেকোনো দেশের জাতীয় সংগীত তাদের দেশ ও জনগণের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের এই গানটিও তেমন এক ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পরে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সংগীত হিসাবে গাওয়া হয়।
এই গানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, তখনকার নেতৃত্বসহ আরো অনেক বিষয় জড়িত। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং তার মূল চারিত্র্যে অসাম্প্রদায়িকতা ছিল এ গান তার প্রমাণ। হয়তো রাগটা ও সেখানে। ধর্ম-বর্ণ-জাত নিয়ে যারা রাজনীতি করেন, তারা এমন চাইবে এটাই স্বাভাবিক। এই গানটি বেছে নেওয়ার কারণও ছিল অনেক। আজ সে কথায় না গিয়ে বলতে চাই একবার আমি একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি বাংলাদেশিদের চাইতে সেখানে বিদেশিদের সংখ্যা অধিক। আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান। পার্লামেন্ট হাউসে। নিয়মমাফিক বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত হবে। অবাক হয়ে দেখলাম বিদেশি অভ্যাগতদের সবাই আমার সোনার বাংলা গাইলেন। কেউ লিখে এনেছিলেন দু-একজন মুখস্ত। পরে তাদের একজন বলেছিলেন যদিও তিনি পুরো গানের অর্থ বোঝেননি কিন্তু সুর আর বাণীর মোহে আচ্ছন্ন ছিলেন এবং অকারণে তার চোখ টলটল করে উঠেছিল। এমন একটি জাতীয় সংগীত পাওয়া জাতির ভাগ্য থেকে তা ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা ফলবতী হবে না। এটাই আমাদের বিশ্বাস।
ভোরের আকাশ/মি/সু
মন্তব্য