-->
শিরোনাম
জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কথাশিল্পী

আবদুল্লাহ আল মোহন
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কথাশিল্পী

আজ কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যয়ের জন্মদিন । বাংলা ভাষার মহান কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টম্বর পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মানুষের মহান কথাকারের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোহর জেলার বনগ্রাম মহকুমার বারাকপুর গ্রামে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাগের সময় বনগ্রাম মহকুমা পুনর্গঠিত হয়ে ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর পিতামহ তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যৌবনে কবিরাজি করার জন্য ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রাম থেকে বারাকপুরে আসেন এবং বারাকপুরের স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ ছিলেন সবার বড়। তাঁর অন্যান্য ভাইবোনেরা ছিলেন ইন্দুভূষণ (১৮ ভাদ্র ১৩০৪), জাহ্নবী দেবী (৬ চৈত্র ১৩০৫), সরস্বতী দেবী (১১ আশ্বিন ১৩০৮), বটুবিহারী (৮ শ্রাবণ ১৩১২)। পিতার কাছে বিভূতিভূষণের পড়ালেখার পাঠ শুরু হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। এর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ভর্তি হন এবং ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায়ও ডিস্টিংশনসহ পাশ করেন। এরপর তিনি কিছুদিন এম.এ এবং ল-ক্লাসে লেখাপড়া করেন। এই সময় তিনি হুগলি জেলার জাঙ্গীপাড়ায় মাইনর স্কুলে শিক্ষাকতা শুরু করেন। কিন্তু সেখানে তিনি অস্থিরতায় কাতর হয়ে, সোনারপুর হরিণাভিতে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে যান। এখানে থাকতেই তিন প্রথম 'উপেক্ষিতা' নামক গল্প রচনা করেন এবং গল্পের সূত্রে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু হয়। গল্পটি প্রবাসী পত্রিকার ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায়(১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর (১৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা রমা দেবীকে (ডাক নাম কল্যাণী) বিবাহ করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় তিনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন এবং এখানকার গোপালনগর স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় তিনি পৈতৃক ভিটার কাছে একটি পুরানো বাড়ি কেনেন এবং এই বাড়ি মেরামত করে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন। বিয়ের পর তাঁর দুটি মৃত কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এরপর পুত্র তারাদাস বন্দোপাধ্যায় (ডাকনাম বাবলু) জন্মগ্রহণ করেন। সংসার জীবনে তিনি তাঁর পিতার মতোই কিছুটা ভবঘুরে জীবনযাপন করেন। ১৯৪২-৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, তিনি বন্ধু এবং বিহার সরকারের বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচরী যোগেন্দ্রনাথ সিন্হার সাথে ছোটনাগপুর বিভাগের সিংভূম, হাজারীবাগ এবং রাঁচী ও মানভূম জেলার অরণ্য ভ্রমণ করেন। এছাড়া দুই-একবার তিনি সারান্দা বনের নিভৃত অরণ্যে বাস করেন।

নানা ধরনের চাকরি করেছেন তিনি। তবে, সময়ের হিসেবে শিক্ষকতাই করেছেন বেশি। কলকাতার ধর্মতলায় খেলাতচন্দ্র ক্যালকাটা ইনস্টিটিউশন বিদ্যায়তনের শিক্ষকতা করেন। বিভিন্নভাবে এদের সঙ্গে বিভূতিভূষণ যুক্ত ছিলেন অনেক দিন পর্যন্ত-১৯২৩ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ।

সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বিভূতিভূষণ সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। তিনি চিত্রলেখা (১৯৩০) নামে একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া হেমন্তকুমার গুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি দীপক (১৯৩২) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র-পুরস্কার’ (১৯৫১) লাভ করেন।

গ্রামীণ জীবনের অসামান্য রূপকার, নিম্নবর্গের কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।সাহিত্য সমালোচকগণ বলছেন, বিভূতিভূষণ যে মানবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তা সারল্যে অসাধারণ। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের পর বাংলা উপন্যাসের প্রবহমান ধারায় তিনি যুক্ত হন বিশ শতকের তিনের দশক শুরুর প্রাকলগ্নে। 'পথের পাঁচালী' (১৯২৯) নিয়ে উপন্যাসের ভুবনে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর তাকে আর ফিরে ডাকাতে হয়নি। বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর তালিকায় স্থান করে নেয় 'পথের পাঁচালী'। এরপর তিনি রচনা করেন আরো ১৩টি উপন্যাস। ফলে তার মোট উপন্যাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪টিতে। এগুলো হলো- 'অপরাজিত' (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৩২),' দৃষ্টিপ্রদীপ' (১৯৩৫), 'আরণ্যক' (১৯৩৯), 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' (১৯৪০), 'বিপিনের সংসার' (১৯৪১), 'দুই বাড়ি' (১৯৪১), 'অনুবর্তন' (১৯৪২), 'দেবযান' (১৯৪৪), 'কেদার রাজা' (১৯৪৫), 'অথৈ জল' (১৯৪৭), 'ইছামতী' (১৯৫০), 'দম্পতি' (১৯৫২) ও 'অশনি সঙ্কেত' (১৯৫৯)। তার সমকালে আর দুজন দাপুটে ঔপন্যাসিক ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে, ১৯০৮-৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৬) ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (২৪ জুলাই, ১৮৯৮-১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।কিন্তু নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীই রচনায় পল্লীর জীবন ও নিসর্গ রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের চালচিত্র ও মানবজীবনের অন্তর্লীন সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনায় প্রকৃতি কেবল প্রকৃতিরূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব রসমূর্তি ধারণ করেছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।

মহান কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর (১৫ কার্তিক ১৩৫৭) বুধবার, রাত্রি ৮টা ১৫ মিনিটে বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version