-->
শিরোনাম

আলোচনাই পারে শ্রমিক অসন্তোষ দূর করতে

আব্দুর রহিম
আলোচনাই পারে শ্রমিক
অসন্তোষ দূর করতে

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ প্রথমেই আঘাত হেনেছিল পোশাকশিল্পে। পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলন এবং সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে বন্ধ হয়ে যায় পোশাক কারখানা। ব্যাহত হয় উৎপাদন। এরই মধ্যে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এক দিকে উৎপাদন বন্ধ; অন্যদিকে ইন্টারনেট নেই- এই পরিস্থিতিতে হতাশায় নিমজ্জিত হয় পোশাকশিল্প। কিছু অর্ডারও বাতিল হয়। ইন্টারনেট সচল হওয়ার পর উদ্যোক্তারা বিদেশি ক্রেতাদের আন্দোলনের কারণে সরবরাহ ব্যাঘাত ঘটার কথা জানান। উদ্যোক্তাদের পাশে থাকার ঘোষণা আসে ক্রেতাদের পক্ষ থেকে। কেটে যায় কালো মেঘ। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট সরকার পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছিল।

কিন্তু সেই অবস্থা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নতুন সরকারের কাছে দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন সংগঠন। এ থেকে বাদ যাননি পোশাক শ্রমিকরাও। তারা বেতন বাড়ানোসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এই সংখ্যা দুইশ’র বেশি। আবার অনেক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় টানা দুই সপ্তাহের শ্রমিক বিক্ষোভে তৈরি পোশাকশিল্প বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দুঃখের বিষয় হলো শুরুতে শ্রমিকদের দাবিকে পাত্তা দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এতো ঘোলাটে হতো না। তারা উসকানিদাতা, বহিরাগত হামলাকারী ও ঝুটট ব্যবসায়ীদের দায়ী করেন। অন্যদিকে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করতেই থাকেন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দাবি আংশিকভাবে মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু এর আগেই শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাভার-আশুলিয়া ও গাজীপুরে ৯৪টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। এর বাইরে দেড়শ কারখানায় ওই দিন উৎপাদন ব্যাহত হয়।

বিভিন্ন পত্রিকার খবর বলছে, তৈরি পোশাক খাতের চলমান অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু হলো আশুলিয়া। সেখানে দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কারখানা রয়েছে। বিজিএমইএ’র কয়েকজন সাবেক সভাপতি এবং বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী মালিকদের কারখানাও আছে সেখানে। মূলত এই সব মালিক-ই মজুরিসহ অন্যান্য আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে কলকাঠি নাড়েন। ফলে চলমান অস্থিরতা নিরসন না হওয়ার জন্য তাদের পুরোনো কৌশলকেই দায়ী করছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের ভাষ্য, গত দেড় দশকে স্থানীয় মাস্তান দিয়ে ভয়ভীতি ও মারধর এবং মামলা-গ্রেপ্তার করে শ্রমিক বিক্ষোভ বা আন্দোলন দমন করেছে মালিকপক্ষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র তত্ত্বও সামনে আনা হয়। এবারও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরনো কৌশলই অবলম্বন করে মালিকপক্ষ। কিন্তু সেই চেষ্টার হালে পানি পায়নি। কারণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না দেশের পণ্য রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। এখাতের শ্রমিকদের দাবির বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। শক্তি প্রয়োগ হিতে বিপরীত হতে পারে। কেননা, এদেশে পোশাক শ্রমিকরাই সব চেয়ে বেশি সংগঠিত এবং সহকর্মীর বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, টঙ্গীতে কোন কারখানায় বেতন-ভাতা নিয়ে সংকট কিংবা কাউকে চাকরিচ্যুত করা হলে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাড্ডার শ্রমিকরাও কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। সুতরাং তাদের দমন করার কোন উপায় আছে বলে মনে করি না। তাদের সাথে আলোচনা করেই সমস্যা সমাধান করতে হবে। একটা আশঙ্কার কথা উল্লেখ করতে চাই। কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং পরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে গত দুই মাসে কয়েক দফা উৎপাদন এবং রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয় পোশাকখাতে। এরপর শুরু হয়েছে অস্থিরতা। ফলে বিদেশি ক্রেতারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আগামী মৌসুমের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয়াদেশ তারা সরিয়ে নিতে পারেন। ব্যবসায়ীদের এই আশঙ্কা সত্যি হলে রপ্তানী আয়ের এই খাতটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে শ্রমিকদের বিষয়টিও সবাইকে ভাবতে হবে। কারণ বর্তমান বাজারদর অনুসারে শ্রমিকরা যে বেতন পান; তা দিয়ে জীবন চালানো কঠিন। এই বাস্তবতা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। গত বছর নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকার মজুরি প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব করে। প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামেন। ওই সময় তিন সপ্তাহের আন্দোলনে চার পোশাকশ্রমিক মারা যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে মালিকপক্ষ নতুন করে সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়; সেটিই চূড়ান্ত হয়। তারপরও আন্দোলন চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ, মামলা ও গ্রেপ্তারের পথ বেছে নেন মালিক ও সরকারপক্ষ। তখন কারখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ বিভিন্ন অভিযোগে শুধু গাজীপুর ও আশুলিয়ায় ৪৩টি মামলা হয়। এসব মামলায় ১১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কারখানাভেদে ৮ দফা থেকে ২৫ দফা দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা। দাবির মধ্যে রয়েছে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি; হাজিরা বোনাস ৮০০-১০০০ টাকা করা; টিফিন বিল ৫০ টাকা; দুই ঈদে ১২ দিন করে ছুটি; ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি। এ ছাড়া কারখানার মধ্যম সারির কিছু কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার দাবিও রয়েছে।

শ্রমিকদের সব দাবি মালিকপক্ষ মানতে পারবেন- বিষয়টা তেমন নয়। কিন্তু যেটা সম্ভব; সেটা করতে হবে। তাদের সাথে বসতে হবে। শ্রমিকদেরও কিছুটা ছাড় দিতে হবে। মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না- অস্থিরতার কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা বিদেশি অর্ডার বাতিল হলে ক্ষতি কিন্তু মালিক-শ্রমিক সবারই হবে। সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে দেশের অর্থনীতির।

 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।

 

ভোরের আকাশ/মি

 

মন্তব্য

Beta version