‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘এনকাউন্টার’ শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা বেশ পরিচিত। কয়েক বছর আগেও সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত এই সব শিরোনামে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হতো। তবে সব ঘটনার স্ক্রিপ্ট একই রকম। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অস্ত্র উদ্ধার করতে যায়। সেখানে ওই ব্যক্তির সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর গুলি চালায়। আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে ওই ব্যক্তি আহত হন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আহত ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করেন ডাক্তার। কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যও আহত হয় বলে দাবি করা হতো। তবে যে নামেই হোক এটা যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড; এতে কোনো সন্দেহ নেই। কাকতালীয়ভাবে কেউ কেউ এই হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণে রক্ষা পেলেও হারাতে হয়েছে অঙ্গ। প্রাণে রক্ষা পাওয়া ব্যক্তিকে সৌভাগ্যবান বলতেই হয়। তাদের একজন বিএনপি কর্মী কামরুল হাসান।
গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের পলোয়ান পাড়ার এই বাসিন্দা। নিজ গ্রামের একটি মাঠে এই সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। তার অভিযোগ, ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তার পায়ে গুলি করা হয়। তিনি বোয়ালখালী উপজেলায় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। সেখানে রাউজান থানার এসআই টুটন মজুমদার কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিয়ে হাজির হন। তাদের সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন সন্ত্রাসী। রাত ১২টার পর তারা তাকে গ্রামের দুই কিলোমিটার দূরের সূর্যসেন পল্লী এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে তার দুই পায়ে গুলি করার পর দুই হাতের কয়েকটি আঙুল কেটে দেন তারা। পরদিন পুলিশ ঘটনাটিকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ দাবি করে তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠায়। তখনকার স্থানীয় সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিমের নির্দেশে পুলিশ ও সন্ত্রাসী বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। তার ভাষ্য, কেবল বিএনপির কর্মী হওয়ার কারণেই নির্যাতন করে তার জীবন বিপন্ন করে তোলা হয়েছে এবং তাকে একাধিক মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ বাবুল মিয়াও তার ওপর চালানো নির্যাতনে জড়িত বলে তিনি দাবি করেন। ঘর থেকে একটি হুইল চেয়ারে করে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন কামরুল হাসান। তার একটি পা নেই। একটি হাতের কনিষ্ঠ আঙুল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। গুলি করার পর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার চারটি আঙুল প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। যদিও তিনটি আঙুল পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জোড়া লাগানো হয়েছে। গুলি এবং ধারালো অস্ত্রের জখমের পর পুলিশ দাবি করে তার কাছ থেকে একটি দেশীয় বন্দুক ও পেট্রলবোমা উদ্ধার করা হয়েছে। ওই সময় তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। অপর পা এখনো নিয়মিত ড্রেসিং করতে হচ্ছে। ওই পা দিয়ে পুঁজ পড়ে।
তিনি দাবি করেন, ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট তাকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ভাড়া বাসা থেকে তুলে নিয়ে অস্ত্র দিয়ে আরেকটি মামলায় ফাঁসানো হয়। আবারও তাকে জেলে যেতে হয়েছে। তাকে রাঙ্গামাটির কাউখালী থানার একটি চাঁদাবাজি মামলায়ও আসামিও করা হয় বলে তিনি দাবি করেন। অভিযুক্ত সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম কারাগারে রয়েছেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মুহাম্মদ বাবুল মিয়া আত্মগোপনে। ফলে তাদের বক্তব্য জানতে পারেননি সাংবাদিকরা। তবে অভিযুক্ত এসআই টুটন মজুমদারের সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিকরা। তার ভাষ্য, দুটি মামলায় পরোয়ানা থাকায় কামরুলকে বোয়ালখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে কামরুলের সহযোগীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। এসআই টুটনের কথা অনুসারে যুক্তির খাতিরে যদি ধরেই নেই কামরুল অপরাধী। তাকে বিচার করার জন্য তো আদালত আছে। তাকে কেন গুলি করে পঙ্গু করে দিতে হবে? তাকে নিয়ে রাতে কেন অস্ত্র উদ্ধারে যেতে হবে? কামরুল যদি অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করেই থাকে; তাহলে পুলিশ কেন সেখানে দিনে গেল না? দিনের বেলায় সেখানে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে জনগণ সব কিছু জানতে পারতো। ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতাও থাক। সেটা যা-ই হোক। অন্তত কামরুলের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হোক। তদন্তে এসআই টুটন মজুমদার দায়ী হলে তার বিচার হোক। একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কোনো সদস্য অপকর্মে না জড়ায়। আর যদি কামরুল ইসলাম মিথ্যা অভিযোগ করেন; তাহলে তারও বিচার হোক।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ১৯ বছরে ৩ হাজার ৮৭৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৪৬৬টি এবং ২০২২ সালে সর্বনিম্ন ১৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং র্যাব ও পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ৬ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসার কারণেই ২০২২ সালে সবচেয়ে কম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৪ সালে ২০৭টি; ২০০৫ সালে ৩৭৭টি, ২০০৬ সালে ৩৫২টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৭ সালে ১৬২টি; ২০১৮ সালে ৪৬৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে; যা ১৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালে ৩৮৮টি এমন হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটি কিছুটা কমে ২২২ হয়। আর ২০২১ সালে দেশে ৮০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ঘটেছে ১৮টি।
২০১৭ থেকে ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে পুলিশ। বাহিনীটির হাতে ৭০৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। একই সময়ে র্যাব ৩৬৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বলেন, ২০১৮ সালে দেশে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলে। সেবছর বিভিন্ন এলাকায় মানুষ নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তাই সেবছর সংখ্যাটি বেশি। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আসার ফলে আমরা দ্রুত দেখলাম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা কমে গেল। এই সময় গুমের ঘটনাও কমে যায়। যদিও পরবর্তীতে ‘জঙ্গি তকমা’ দিয়ে অনেককে তুলে নেওয়া হয়। অনেককে আবার আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন ঘটে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্র যখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ধাবিত হয় এবং জনগণ যখন তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, জনসমর্থিত না এমন সরকার নির্বাচিত হয়, সরকার যখন জনবিচ্ছিন্ন থেকে তার কাজ পরিচালনা করতে চায়, তখন নানা দিক থেকে সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হতে পারে। এটি সরকার স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। সেই কারণে সমাজে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়। যেখানে মানুষ তার অধিকার নিয়ে কথা বলবে না। এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। যার কারণে মানুষের মধ্যে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে। বিচার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ না হওয়ার কারণ কী? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার যারা পরিচালনা করেন, তারা চাইলে রাতারাতি ক্রসফায়ার বন্ধ সম্ভব। গুমের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য