১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর শিক্ষার প্রতি পাকিস্তান সরকারের আগ্রহ ছিল কম। ১৯৫০-এর দশকে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আনুমানিক জিডিপির ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও তার বেশি অংশ ব্যয় হতো উচ্চশিক্ষার খাতে এবং তা-ও পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানের ২৫ বছরের শাসনামলে পূর্ব বাংলার বরাদ্দ মূল শিক্ষা বরাদ্দের ৩৫ শতাংশের বেশি হয়নি।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে পাকিস্তান আমলে পরপর বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাবিদেরা শিক্ষা কমিশনে নিজ নিজ বক্তব্য ও প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। কমিশন তাদের প্রস্তাব তদানীন্তন সরকারের কাছে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কোনো শিক্ষা কমিশনের নীতিমালা নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়নি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান গঠন করেন প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিশন। বাংলাদেশের সর্বজনস্বীকৃত শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে এটা গঠন করা হয়েছিল। নেতৃত্ব পেলেন ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা। সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিলেন স্বীয় অবদানের পরিচয়ে, রাজনৈতিক আনুগত্যে নয়।
কুদরাত-এ-খুদা কমিশন ধৈর্যের সঙ্গে নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করেছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রেখেছে। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৪-১৯৭৮) কমিশন প্রস্তাবিত নীতিগুলোর প্রাথমিক স্তর প্রতিফলিত হওয়ার প্রয়োজনে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের কর্মীদের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রেখেছিল। খুদা কমিশন ১৯৭৩ সালের জুন মাসে সরকারের কাছে কমিশনের রিপোর্ট উপস্থাপন করে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবগুলোয় তাঁর আকাঙ্ক্ষিত শিক্ষানীতিগুলোর বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অনুধাবন করেছিলেন। তিনি শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবগুলো প্রতিপালনের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অর্পণ করেন। তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছিল প্রয়োজনীয় অর্থের ফিরিস্তি তৈরি করতে।
জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হলে জাতি-ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা কমিশনের সুচিন্তিত নীতিমালা বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন শিক্ষাধারার সঙ্গে প্রবাহিত অন্তর্নিহিত বৈষম্য দূর করবে এবং সুদূর দৃষ্টিপ্রয়াসী সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সহযোগী হবে এমনটাই প্রত্যাশা করি। মনে রাখতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা শুধু একটি প্রতিষ্ঠিত কাঠামো নয়, বরং একটি উন্নয়নপ্রক্রিয়া।
সেই সময়ে শিক্ষা খাতে বাজেটের বরাদ্দ আমাদের জিডিপির ২ শতাংশের কম ছিল। অথচ সেই দশকে এশীয় দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপির ৬ শতাংশে উন্নয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার প্রথম ২৫ বছর শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের কাছে থেকেছে এবং পরের ২৫ বছরে জিডিপির ৩ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করেছে। অন্যদিকে কিছু এশীয় দেশের বরাদ্দ জিডিপির ৬ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে। এত স্বল্প অর্থে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম চালিয়ে যেতে নজর দিয়েছে সংখ্যা বৃদ্ধিতে, শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধিতে নয়।
যুগোপযোগী শিক্ষাকাঠামো ও নীতিমালা প্রণয়নের জন্য নতুন জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রয়োজন আছে। অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে ছয়টি অঙ্গনে সংস্কার কর্মধারা শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। এই সংস্কারগুলো টেকসই করতে হলে সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন হবে। সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ঘোষণার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ইতিমধ্যে বর্তমান আর্থিক বছরে (২০২৪-২০২৫) শিক্ষা খাতে দুটি প্রয়োজনীয় এবং সহজসাধ্য পদক্ষেপ অন্তর্র্বতী সরকার বিবেচনা করতে পারে। এর মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে, বর্তমান বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমপক্ষে জিডিপির শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা। বর্ধিত বরাদ্দের ৬০ ভাগ প্রাথমিক শিক্ষা খাতে এবং বাকি অংশ আনুপাতিক হারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া। প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বর্ধিত অর্থ ব্যয় হবে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পুষ্টি সাধনে, নাশতা ও দুপুরের খাবার সরবরাহে, স্বাস্থ্যগত সেবা প্রণয়নে এবং প্রধানত গ্রামে মেয়েদের জন্য টয়লেট স্থাপনে।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হতে পারে, প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্ধারিত ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন আঙ্গিক যোজনা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষককে সহায়তা প্রদান করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি ‘প্রাথমিক বিদ্যালয় সহায়ক পর্ষদ’ (প্রাবিসপ) গঠিত হতে পারে। এটি হবে ৯ থেকে ১১ সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
পর্ষদে থাকবেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা। বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের তিনজন প্রতিনিধি অভিভাবক। সুশীল সমাজের দুজন প্রতিনিধি এবং সেই অঞ্চলের কলেজ বা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুজন অধ্যয়নরত ছাত্র প্রতিনিধি। প্রধান শিক্ষক তাঁর দায়িত্ববলে পর্ষদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। পর্ষদে নারী ও পুরুষের যথাযথ সমতা থাকবে। সহায়ক পর্ষদের প্রত্যেক সদস্য নির্বাচিত হবেন অধ্যয়নরত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সম্মিলিত অভিমতে।
পর্ষদের সমন্বয়ক নির্বাচিত হবেন সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে। পর্ষদের দায়িত্ব হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধান। প্রতিটি বিদ্যালয়ের সুষম খাদ্য প্রদানের ব্যবস্থা, বিদ্যালয় অঙ্গন ও পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা, শাকসবজির বাগান করা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা বিধানব্যবস্থা পর্ষদ পর্যালোচনা করবে এবং কাঠামো নির্ধারণ করবে।
প্রয়োজনে সমাজের অবহেলিত বয়স্ক লোকদের দেখভালের জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করবে। সহায়ক পর্ষদের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রধান শিক্ষকের সম্মতিক্রমে পালিত হবে। প্রধান শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও শিক্ষা প্রদান প্রণালির পূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় নতুন আঙ্গিক সংযোজিত হলে বর্তমানে স্থবির প্রতিটি শিক্ষালয়ে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চারিত হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষালয়ের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক কর্মী, সমাজের নতুন আস্থায় উজ্জীবিত হয়ে শিক্ষা প্রদান প্রক্রিয়াকে সচল করে তুলবেন। এর ফলে বাংলাদেশের ১ লাখ ২০ হাজার বিদ্যালয়ে সৃজনশীলতার ঢেউ জেগে উঠবে বলে আশা করি।
জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হলে জাতি-ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা কমিশনের সুচিন্তিত নীতিমালা বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন শিক্ষাধারার সঙ্গে প্রবাহিত অন্তর্নিহিত বৈষম্য দূর করবে এবং সুদূর দৃষ্টিপ্রয়াসী সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সহযোগী হবে এমনটাই প্রত্যাশা করি। মনে রাখতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা শুধু একটি প্রতিষ্ঠিত কাঠামো নয়, বরং একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়া।
লেখক: বিশ্বব্যাংকের শিক্ষাবিষয়ক সাবেক কর্মকর্তা
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য