পলিথিনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেক। চোখ জ্বালা করা, শ্বাসকষ্ট, লিভারের সমস্যা, ক্যান্সার, চর্মরোগ থেকে শুরু করে অনেক মারাত্মক রোগের জন্য পলিথিন দায়ী। আমরা বাজারে গেলে পলিথিনে করেই সব কিছু নিয়ে আসি। এমনকি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যও।
অথচ পলিথিনে মোড়ানো এসব খাবারই খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। মাছ-মাংস পলিথিন ছাড়া আমরা রাখি না। কিন্তু পলিথিনে মাছ-মাংস প্যাকিং করলে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। প্লাস্টিকের বর্জ্য মাইক্রো ও ন্যানো কণা রূপে মানুষের শরীরে ঢুকে হরমোনজনিত নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে।
এটি মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু উৎপাদন ব্যাহত করছে। ক্যান্সারসহ ত্বকের নানা রকম রোগ সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ কলের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে, যেখান থেকে প্রতি মাসে ২১ গ্রাম এবং বছরে ২৫০ গ্রাম এই প্লাস্টিক মানুষের শরীরে ঢুকে গুরুতর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফথেলেটস, বিসফেনোন, অর্গানোটিনস, পার ও পরি ফ্লোরোঅ্যালকাইল, বিসফেনল এ প্রভৃতি রাসায়নিক উপাদান প্লাস্টিকে থাকে, যা স্থূলতা, গর্ভধারণের ক্ষমতা হ্রাস, বিভিন্ন স্নায়ুরোগ ঘটাতে পারে। প্লাস্টিক জনস্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি নয় শুধু। এটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করছে। পলিথিনে, বিশেষ করে রঙিন পলিথিনে থাকে সিসা ও ক্যাডমিয়াম, যা চর্মরোগের জন্য দায়ী। অথচ এই পলিথিন ছাড়া আমরা যেন অচল।ঢাকা শহরে একেকটি পরিবার দিনে চারটি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। শুধু ঢাকায়ই এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয় প্রতিদিন।
বিশ্বে প্রতিবছর প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয় প্রায় ৪৫ কোটি টন। প্লাস্টিক বর্জ্য ৪০০ বছর পর্যন্ত পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব রাখতে পারে। প্লাস্টিক দূষণকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। প্লাস্টিক এখন সাগরের তলদেশ থেকে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয় প্রায় পাঁচ লাখ। বিশ্বে বছরে ৮০ লাখ টন বর্জ্য সাগরে মেশে। একটি গবেষণার তথ্য মতে, দোকানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ২০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর বোতল হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ৪৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিদিন তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ঢাকায় প্রতিদিন ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। ঢাকার মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ৩৭.২ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০ শতাংশ মেশে রাস্তাঘাট আর নদীতে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, আমাদের দেশে প্রতিবছর আট লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ দুই লাখ ২৮ হাজার টন পুনরায় ব্যবহৃত হয় আর বাকি অংশ পরিবেশেই থেকে যায়।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার এক বিলিয়ন ডলারের। প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। ঢাকায় প্রতিদিন এক কোটি ২০ লাখ পলিব্যাগের বর্জ্য ফেলা হয়। প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছেই।
বাংলাদেশে ২০০৫ সালে এর বার্ষিক মাথাপিছু ব্যবহার ছিল তিন কেজি। এটি বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছে ৯ কেজি। অর্থাৎ ১৫ বছরে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণ। সরকারের এসব প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের আলাদা কৌশল রাখতে হবে। যেমন শুধু প্লাস্টিকের জন্য আলাদা কনটেইনার রাখা যেতে পারে। রিসাইক্লিং করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন কম্পানি, যারা প্লাস্টিকে পণ্য বিক্রি করে, তাদের এসব প্লাস্টিক ব্যবহার করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলার পরিকল্পনা থাকা জরুরি।
বাংলাদেশই বিশ্বে প্রথম প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ২০০২ সালে। ২০১০ সালে প্লাস্টিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ন্যাশনাল থ্রিআর (৩জ) নীতি চালু করে। ন্যাশনাল থ্রিআর অর্থ হলো রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকল। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার জুট প্যাকেজিং আইন পাস করে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ১ অক্টোবর থেকে সুপারমার্কেট এবং ১ নভেম্বর থেকে সব কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এটি ভালো কাজ। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে বাজারে যেন এসব ব্যাগের বিকল্প থাকে। সরকার বলছে, এর বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগের সরবরাহ থাকবে। শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই কাজ হবে না। পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেই এটি সফল হবে। দোকানি বা ব্যবহারকারীদেরই এ ক্ষেত্রে নজরে আনলে চলবে না। পলিথিন উৎপাদনকারীদের ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য