-->

ঐক্যের প্রতীক দেবী দুর্গা

অমল সরকার
ঐক্যের প্রতীক দেবী দুর্গা

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। বাংলাদেশেও আবাহমান কাল ধরে বাঙালি হিন্দুরা মহাআড়ম্বরে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করে থাকেন। দেবী দুর্গার আরাধনায় জাতপাত তুচ্ছ করে ঐক্যের মহামন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে পালিত হয় এই পূজা। তাই দেবী দুর্গাকে ঐক্যের প্রতীক বলে থাকেন ভক্তরা।

ভক্তদের বিশ্বাস পৃথিবীতে যখন অশুভ শক্তির উদ্ভব হয়; তখন শুভ শক্তি পরাজিত হয়ে নির্যাতিত লাঞ্ছিত হতে থাকেন। সেই সময় দেবী দুর্গাকে ডাকলে তিনি ভক্তের মনবাঞ্ছা পূরণ করতে ঐশ্বরিক ক্ষমতা দ্বারা তার ভক্তকে উদ্ধার করেন। সুর অর্থ সুন্দর ও শুভ; এর বিপরীতে যে শক্তি কাজ করে; যে ঈশ্বর মানে না; নিজেই ঈশ্বরসম ভেবে মানব এবং ধরার ক্ষতি সাধন করে চলে তাকেই অসুর বলা হয়।

হিন্দু শাস্ত্র শ্রী শ্রী চণ্ডিতে বর্ণিত আছে- সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মাকে কঠোর তপস্যায় তুষ্ট করেন ভক্ত মহিষাসুর। তিনি ব্রহ্মার কাছে অমরত্ব বর প্রার্থনা করেন। কিন্তু অমর একমাত্র দেবতারাই হন; অন্য কেউ নন। একথা বলে ব্রহ্মা তাকে অন্য কোনো বর চাইতে বলেন। কিন্তু মহিষাসুর এতে রাজি হন না। স্বর্গে ফিরে যান ব্রহ্মা। মহিষাসুর আবার কঠোর তপস্যায় বসে ব্রহ্মাদেবকে ডাকতে থাকেন। ভক্তের ডাকে আবার তিনি মহিষাসুরকে দেখা দেন। বলেন, কি চাও? এবারও একই দাবি জানালেন মহিষাসুর। এতে রাজি হন না ব্রহ্মাদেব। কিন্তু তপস্যা ছাড়েননি তিনি। ফের তাকে ডাকতে থাকেন। তৃতীয় বার ব্রহ্মাদেব বলেন, তুমি অমরত্ব পাবে; কিন্তু রমনী হবে তোমার সংহারের কারণ। মহিষাসুর ভাবলেন নারী? ব্রহ্মার বর পেয়ে আমি অমর হচ্ছি। সামান্য নারী তো তুচ্ছ। খুশি মনে মেনে নেন ব্রহ্মার বর।

অমরত্বের বর পেয়ে মহিষাসুর একের পর এক অধর্ম করতে লাগলেন। মহাভারতে বর্ণিত আছে- মহিষাসুর মর্ত্য ও পাতাল দখল করে স্বর্গ আক্রমণ করেন। যেখান থেকে দেবরাজ ইন্দ্রকে গদিচ্যুত করেন এবং দেবতাদের তাড়িয়ে দেন তিনি। স্বর্গচ্যুত দেবতারা ভগবান বিষ্ণুদেবের শরণাপন্ন হন। তিনি ব্রহ্মা, শিব ও অন্য দেবতাদের একত্রিত করে মহিষাসুরের বিনাশের পরিকল্পনায় এক নারী শক্তি সৃষ্টি করেন। ওই নারী শক্তিই সম্মিলিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরসহ দশ দেবতার শক্তি-ক্ষমতাপ্রাপ্ত নারায়ণী বা দেবী দুর্গতি নাশিনী দুর্গা। দেবী দুর্গা মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে পরাস্ত করে স্বর্গ উদ্ধার করেন। তাই দেবতাগণ তার নাম রেখেন দুর্গতি নাশিনী দেবী দুর্গা।

হিন্দুদের বিশ্বাস- ভক্তদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে যেকোনো রূপই প্রকাশ করে থাকেন দেবী দুর্গা। ঈশ্বর দেবী দুর্গা রূপে ভক্তদের উদ্ধার করেছেন; তাই তিনি ওই রূপেই পূজিত হন।

দুর্গা নামের ব্যুৎপত্তি হলো- দুর্গম অর্থাৎ যে স্থানে গমন করা অত্যন্ত দুরহ তাকে দুর্গ বলে। সঙ্গে আ প্রত্যয় যোগ করে দুর্গা শব্দটি আসে এবং নারী রূপ দেয়া হয়েছে। তিনি মহামায়া, তিনি দুরধিগম্য; তাকে দুঃসাধ্য সাধনার দ্বারা পাওয়া যায়। তাই তিনি দেবী দুর্গা। দুর্গম নামক অসুরকে বধ করার কারণে দেবীকে দুর্গা বলে ডাকা হয়। তিনি ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক আদ্যশক্তি মহামায়া অর্থাৎ মহাজাগতিক শক্তি, তিনি জয় দুর্গা, জয় যগধাত্রী, গন্ধেরশ্বরী, চণ্ডি, নারায়ণী, উমা ও পার্বতী নামেও পূজিত হন।

দেবী দুর্গা দশ শক্তির সম্মিলনে কর্ম করেন, তাই তাকে দশ ভুজা বা দশ হাত, ত্রিনয়না দেবী বলা হয়ে থাকে। তার এক চোখ সূর্য, অন্য চোখ চন্দ্র ও ললাট নয়নকে জ্ঞান চক্ষু বলা হয়। তার দশ হাতে দশটি অস্ত্র থাকে। সিংহ তার বাহন; যা শক্তির প্রতীক।

আদিকাল থেকে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বা বড় পূজা বলা হয়ে থাকে দুর্গাপূজাকে। বিশে^র বিভিন্ন দেশেও দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। তিথি অনুসারে বছরে দু-বার দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। আশি^ন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয় এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী পূজা নামে দুর্গাপূজা হয়। বাংলাদেশে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের অমাবশ্যায় মহালয়া দিয়ে পূজা শুরু হয়। আর ঝড়-বৃষ্টিরকালে পূজিত হয় বলে একে অকালবোধন বলা হয়। কৃত্তিবাস প্রণীত শ্রী শ্রী রামায়ণের বর্ণনা অনুসারে, রাম চন্দ্র রাবনের সঙ্গে যুদ্ধে শক্তি প্রার্থনার জন্য অকালেই দুর্গাপূজা করেছিলেন। সেই বিশ্বাস থেকেই হিন্দুরা অকালবোধন দুর্গাপূজা করে আসছেন।

পুরাণে বর্ণিত আছে- দুর্গাপূজা তখনই সার্থক হবে; যখন দেখা যাবে তার ভক্তগণ শুধু উৎসবেই মনোযোগ না দিয়ে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসুরকে নীতি-বিবেক দ্বারা বধ করে সুর মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মানব কল্যাণে স্বীয় শক্তির সম্মিলনে ঐক্যের সিঁড়ি বেয়ে সমাজকল্যাণের কর্মে নিজেকে নিবেদিত করবেন; তখনই দুর্গাপূজার মাহাত্ম প্রতিফলিত হবে। তবেই শুভ বিজয়া দশমীর সার্থকতা ঘরে ঘরে বিরাজ করবে।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version