-->
শিরোনাম
জহুরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

মানব সেবায় অনন্য অবদান ছিল যার

রাহিমা আক্তার
মানব সেবায় অনন্য অবদান ছিল যার

কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার ভাগলপুর একটি ঐতিহ্যবাহী বর্ধিষ্ণু গ্রাম, এই গ্রামেরই এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৮ সালের ১লা আগষ্ট রোজ বুধবার জহরুল ইসলাম জন্ম গ্রহন করেন । তাঁর পিতা আলহাজ্ব আফতাব উদ্দিন আহম্মদ ও মাতা রহিমা আক্তার খাতুন। তার পিতা ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব । তিনি ১৯৫৮-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বাজিতপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।

অত্র এলাকার জনহিতকর কর্মকান্ডে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। জহরুল ইসলাম এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ধারক ও বাহক। মুঘল আমলের মধ্য ভাগে জহরুল ইসলামের পূর্ব পুরুষ তিন ভাই বাজেত খাঁ,ভাগল খাঁ ও দেলোয়ার খাঁ মুঘল শাহের দরবারী আমলা হয়ে এই এলাকায় আসেন। যার পরবর্তীতে বাজেত খাঁর নামানুসারে বাজিতপুর, ভাগলখাঁর নামানুসারে ভাগলপুর ও দেলোয়ার খাঁর নামানুসারে বর্তমান দিলালপুর নামকরণ হয়। জহুরুল ইসলাম ভাগলখাঁর পরিবারের ত্রয়োদশ বংশধর। শৈশবে জহুরুল ইসলাম কে সবাই সোনা বলে ডাকতো ও যৌবনে পরিচিতরা জহুর ভাই বলে সম্ভোধন করতেন । আর তিনি তার ব্যবসা ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সাহেব হিসেবে কর্মকর্তা কর্মচারীগণ সম্ভোধন করতেন। ক্রীড়া অনুরাগী জহুরুল ইসলাম মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্য ছিলেন ও নাভানা ক্রিকেট টুনামেন্টের তিনি পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

জহরুল ইসলাম স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণী শেষ করে কিছু দিন সরার চর শিবনাথ হাইস্কুলে অধ্যয়ন করেন তারপর বাজিতপুর হাই স্কুলে উচ্চতর শ্রেণীতে লেখাপড়া চলা কালীন চাচা মহকুমা প্রকৌশলী মুর্শিদ উদ্দিনের সাথে কলকাতায় চলে যান। সেখানে ইংরেজী মাধ্যমে কলকাতা রিপন হাই স্কুল থেকে মেট্টিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্ধমান জেলার এক কলেজে আইএ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে পরিস্থিতির চাপে চলে এসে কিছু দিন মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে অধ্যয়ন করেন। প্রতিকুল পরিবেশ ও পরিবারিক দায় দায়িত্বের চাপে তিনি আর লেখাপড়ায় এগোতে পারেননি।

সেই জন্যই হয়তো শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি ছিলে আজীবন মুক্ত হস্ত। ১৯৪৮ সালে মাত্র ৮০ টাকা মাসিক বেতনে সি এন্ড বি এর ওয়ার্ক এসিস্টেন্ট এর চাকুরীতে নিযুক্ত হন। তিন বছর পর ১৯৫১ সালে চাকুরীতে ইস্তেফা দেন। এবার তিনি ঠিকাদারী কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। প্রথম ঠিকাদার হিসেবে তিনি এক সরকারী অফিসে ১২শত টাকার ষ্টেশনারী সরবরাহ করেন। তারপর তিনি কিশোরগঞ্জে পোষ্ট অফিস নির্মাণ পরবর্তীতে গুলিস্থান থেকে টিকা টুলী সড়কের ঠিকাদারী পান। এর পর থেকে তাকে আর পিছু ফিরতে হয়নি। মাত্র ২ বছরের মাথায় নিজেকে তিনি একজন ১ম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হবার সাথে সাথে তিনি পিতার ১৩ সদস্যের পরিবার কে ঢাকায় নিয়ে আসেন ও ১৩ সদস্যের একান্নবর্তী পরিবার এক সময় বিশাল এক পরিবারে রুপ নেয় যা তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন।

সিলেটের জামাতা জহুরুল ইসলাম: ১৯৫৬ সালে সিলেট জেলার বিয়ানী বাজার থানার স্বনামধন্য পরিবারে অধ্যাপক মোশাহেদ আলী চৌধুরী সাহেবের কন্যা সুরাইয়া বেগমের সাথে তিনি বৈবাহিক বাধনে আবদ্ধ হোন। সুরাইয়া বেগম ছিলেন তার অনুপ্রেরণা।

দেশের প্রথম এই ধনকুব ১১ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। সাংসারিক জীবনে জহুরুল ইসলামের এক ছেলে মঞ্জুরুল ইসলাম (বাবলু) আর চার মেয়ে সাইদা ইসলাম (বেবী), মাফিদা ইসলাম (শিমি), নাইমা ইসলাম (ইমা), কানিতা ইসলাম (কানিতার) জনক ছিলেন তিনি। জহুরুল ইসলাম সিএন্ডবিতে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেন সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ক্ষুদ্র ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬৫-এ তিনি ইষ্টার্ন হাউজিং লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। জহুরুল ইসলাম ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে কিশোরগঞ্জে খুলেছিলেন দুই শত লঙ্গর খানা। এসব লঙ্গর খানায় সকল দরিদ্র অভুক্ত মানুষের জন্য ৫ মাস ব্যাপী খাদ্য নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিডিসি)।

এ কর্পোরেশন বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান যা মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্মাণ ব্যবসা শুরু করে। তার কোম্পানী বাংলাদেশ সংসদ ভবনের আঙ্গিনা,বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন, বাংলাদেশ হাইকোর্ট ভবন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বিল্ডিং, এমপি হোস্টেল ও বাংলাদেশের প্রধান প্রধান মহাসড়ক সমূহ নির্মাণ করে। তিনি পাট ও আসবাবপত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ব্যবসার মধ্যে রয়েছে নতুন প্রযুক্তিতে আবুধাবিতে ৫০০০ বাড়ি নির্মাণ, ইরাক ও ইয়েমেনে উপ শহর নির্মাণ ইত্যাদি। এই সকল কাজের মাধ্যমে তিনি দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।

বাংলাদেশের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি কিংবদন্তি। ১৯৮৯ সালে তিনি নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, গ্রামীন পরিবেশে নির্মিত মেডিকেল কলেজ বর্তমানে ও বাংলাদেশের উল্লেখ যোগ্য প্রতিষ্ঠান যা সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর লেখা, ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জহুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ জুন ঢাকা ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান। সেখানে তিনি ‘সুবেদ আলী’ ছদ্ম নাম ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে মোটা অংকের নগদ আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের জেলে আটক নেতাকর্মীদের মোকদ্দমাদির খরচ, আহতদের চিকিৎসার খরচ ও ঐতিহাসিক আগর তলা মামলার খরচ ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন। এভাবে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন মুক্তি আন্দোলনে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেকে সম্পৃক্ত করে।

নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই হিসেবে তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযোদ্ধা। জহুরুল ইসলাম ছিলেন এদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি এক অসাধারণ। বাঙালি কৃতী সন্তান, যার তুলনা শুধু তিনি নিজেই। তার মহত্ত্ব, কৃতিত্ব ও আদর্শ তথা দেশপ্রেম বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য পাথেয় ও অমর হয়ে থাকবে।

শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সমূহ:১। ইষ্টার্ন হাউজিং লিঃ২। বেঙ্গল ডেভলপমেণ্ট কর্পোরেশন লিঃ৩। দি মিলনার্স টিউবয়েলস লিঃ৪। এসেনশিয়াল প্রডাক্টস লিঃ৫। নাভানা ইন্ডাষ্টিজ লিঃ৬। ক্রিসেন্ট ইন্টারনেশনাল লিঃ৭। ঢাকা ফাইবার্স লিঃ৮। নাভানা ফার্মাসিঊটিক্যালস লিঃ৯। নাভানা লিঃ১০। দি রিভার ভিঊ লিঃ১১। আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিঃ১২। দি মিলনার্স ইঞ্জিনিয়ারিং কো লিঃ১৩। দি মিলনার্স লিঃ১৪। ইষ্টার্ন এষ্টেট লিঃ১৫। আলস লিঃ ( অধুনা স্থগিত)১৬। ভাগলপুর ফার্মস লিঃ১৭। ভাগলপুর এষ্টেট লিঃ (অধুনা স্থগিত)১৮। নাভানা স্পোর্টস লিঃ ( অধুনা স্থগিত)১৯। ইসলাম ব্রাদার্স প্রপার্টিজ লিঃ২০। আল-হামরা গ্লাস ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ২১। দি মিলনার্স ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ২২। দি মিলনার্স পাম্পস লিঃ

বাঙালীর গর্ব,দেশ বরেন্য সমাজ সেবক শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম ১৯৯৫ সনের ২৬শে সেপ্টেম্বর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সিংগাপুর গেলে সেখানে ১৮ই অক্টোবর দিবাগত রাত ২ দুটো ৩০ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।

লেখক: সহকারী শিক্ষক

মন্তব্য

Beta version