আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও এখনো ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের অবস্থা খুবই গুরুতর। তবে দারিদ্র্য যে বিমোচন হচ্ছে সে কথা স্বীকার করা যাবে না। আর এই সমস্যা শুধু যে বাংলাদেশে বিরাজমান তা আমরা মনে করি না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখনো বাংলাদেশে কোটি ১৭ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের তথ্যমতে বাংলাদেশে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করছে। তার মধ্যে অতিদারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করছেন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নীচে রেখে সার্বিক উন্নয়নের কথা ভাবা যেন দুষ্কর বিষয় বলে আমরা মনে করি।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ যার অর্থনৈতিক সমস্যার মাঝে দারিদ্র্য অন্যতম। সমাজ নির্ধারিত সাধারণ জীবনযাত্রার মানের চেয়ে যাদের জীবনযাত্রার মান কম তারাই দরিদ্র এবং এই দরিদ্র অবস্থাকেই দারিদ্র্য বলে। বাংলাদেশের পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনার প্রদত্ত দারিদ্র্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী, দারিদ্র্য বলতে জীবনযাত্রার ন্যূনতম মানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার হতে বঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক অবস্থা বোঝায়। দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সমস্যা। অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ করতে না পারাই হলো দারিদ্র্য। একটি ন্যূনতম পরিমাণ আয় উপার্জন ছাড়া এ সমস্ত অভাব পূরণ করা যায় না। তাই একটি ন্যূনতম পরিমাণ আয় উপার্জন করতে না পারাই হল দারিদ্র্যতা।
বলা চলে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, বৈশ্বিক সংঘাত-যুদ্ধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসে অর্জিত অগ্রগতি ঝুঁকিতে আছে। যার প্রভাবে গ্রাম থেকে শহরের পড়ছে। দেশে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। যা ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পথে বিরাট বাধা। জীবিকা হারানো, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ-সংঘাত, নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট ব্যবধান বাদ পড়া জনগোষ্ঠীকে আরও প্রান্তের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশের মুখ্য উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ তার দারিদ্র্যের হার কমাতে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করছে এবং বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশের বড় সুযোগ রয়েছে। সরকার প্রদত্ত সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে ৩৭ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে টিসিবি ফ্যামিলি কার্ড সেবা সর্বোচ্চসংখ্যক তথা ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ পরিবারের কাছে পৌঁছেছে। এ ছাড়া বার্ধক্য ভাতা ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, বিধবা, স্বামী নিগৃহীত, দুস্থ মহিলা ভাতা ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ, আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ভাতা ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছেছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই অর্থাৎ ৪৭ শতাংশ সেবা খাতে নিযুক্ত, ৩৬ কৃষি ও ১৮ শতাংশ শিল্প খাতে কর্মরত। জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। গ্রামীণ এলাকায় এ হার ৩ দশমিক ৬ এবং শহরাঞ্চলে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে রয়েছে।
আমরা মনে করি, দারিদ্র্যবিমোচন ছাড়া বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এখন উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। বিগত সরকার যে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা ঘোষণা দিয়েছে তা বাস্তবায়নে নিতে হবে উদ্যোগ। আমরা আর পিছিয়ে থাকতে চাই না। মাথা উঁচু করে বিশে^র বুকে উন্নত জাতি হিসেবে দাঁড়াতে চাই। আর সেটা বাস্তবায়নে নিতে হবে দারিদ্র্যবিমোচনে পরিকল্পিত উদ্যোগ। সেই লক্ষ্যে সরকার কাজ করবে বলে আমরা আশাবাদী।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য