জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের অনেক সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এখন কারাগারে। তারা বিচারের প্রহর গুণছেন। অনেকে আবার পালিয়ে গেছেন। অস্ত্র ও গুলি লুট হয়েছে। থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে পুলিশ কিন্তু মনোবল হারিয়ে ফেলেছে বলা চলে। অনেক পুলিশ সদস্য এখনও ট্রমার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন। তারপরও এই বাহিনীর সদস্যরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে মঙ্গলবার শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রাজশাহীর চারঘাটে সারদা পুলিশ একাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপপরিদর্শককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার একাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিক) তারেক বিন রশিদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ আদেশ দেওয়া হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি প্যারেড মাঠে ১ অক্টোবর সকাল ৭টা ২৫ মিনিট থেকে ৪০তম বিসিএস (পুলিশ) প্রবেশনারস ব্যাচ-২০২৩-এর সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুশীলন প্যারেড কার্যক্রম চলমান ছিল। এ সময়ে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদা, রাজশাহী কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত মেনু অনুযায়ী প্যারেডে অংশগ্রহণকারী সব প্রশিক্ষণার্থীর প্যারেড বিরতিতে সকালের নাশতা পরিবেশন করা হয়। কিন্তু আপনি উক্ত সরবরাহকৃত নাশতা না খেয়ে হইচই করে মাঠের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। আপনি অন্যান্য প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআইদের পরস্পর সংগঠিত করে একাডেমি কর্তৃপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করে চরম বিশৃঙ্খলা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে থাকেন। এ ছাড়া আপনি অন্যদের সঙ্গে হইচই করতে করতে নিজের খেয়ালখুশিমতো প্রশিক্ষণ মাঠ থেকে বের হয়ে নিজ ব্যারাকে চলে যান। একজন প্রশিক্ষণরত ক্যাডেট এসআই হিসেবে এরূপ আচরণ এবং বিনা অনুমতিতে প্যারেড মাঠ থেকে বের হয়ে নিজ ব্যারাকে চলে যাওয়া সম্পূর্ণভাবে শৃঙ্খলা পরিপন্থী। আপনার এরূপ আচরণ মাঠের সার্বিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে চরমভাবে ব্যাহত করেছে এবং অন্য প্রশিক্ষণার্থীদের শৃঙ্খলা ভঙ্গে উৎসাহিত করেছে মর্মে আপনার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে পুলিশ পরিদর্শক মহসিন আলী (বিপি- ৬৯/৮৭০০১৫২০) বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত আইজিপি) বরাবর লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।’ চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ওই অভিযোগের কারণে একাডেমির অধ্যক্ষের পক্ষে পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন অ্যান্ড লজিস্টিকস) তিন দিনের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করার জন্য নির্দেশনা দেন। আপনি নির্ধারিত তিন দিন সময়ের মধ্যে কৈফিয়তের জবাব দাখিল করেন। আপনার দাখিলকৃত কৈফিয়তের জবাব পর্যালোচনান্তে সন্তোষজনক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। আপনার উপরোক্ত শৃঙ্খলাবিরোধীকর্মকাণ্ড বাংলাদেশ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল পদ হিসেবে বিবেচিত সাব-ইন্সপেক্টর পদে কাজ করার পথে বড় ধরনের অন্তরায় ও অযোগ্যতার শামিল।’
এখন কথা হলো পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা অবশ্যই চৌকস, দক্ষ ও জ্ঞানী। তারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম বলে মনে হচ্ছে। আমার জানা ভুল না হলে অতীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে কারো চাকরি যায়নি। এক যোগে প্রশিক্ষণরত ২৫২ এসআইর অব্যাহতির ঘটনাকে নজিরবিহীনও মনে হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণে এর পেছনে রাজনীতির কারণ থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে। কেননা, এই পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়োগ হয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। দলীয় লোকদের আওয়ামী লীগ সরকার নিয়োগ দিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে নিয়োগ করা পুলিশ কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছে বিএনপি। গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগ মুহূর্তে নিয়োগ করা ৮০৩ জন এসআই এবং ৬৭ জন এএসপির নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছিল। এই দাবি কারণে তাদের বাদ দেওয়া হলো কিনা, সেই বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, এই এসআইদের চাকরিচ্যুতির পেছনে রাজনীতি নেই। তিনি বলেন, শৃঙ্খলার সংজ্ঞা তো অনেক বড়। এটা তো একাডেমি বলতে পারবে। আমাদের সেনাবাহিনীতে দেখছি পাসিং আউটের আগের দিনও অনেককে ফেরত পাঠানো হয়। এত বড় সংখ্যায় ক্যাডেট এসআইকে অব্যাহতি দেওয়ার ফলে যে শূন্যতা তৈরি হল, তা কীভাবে পূরণ করা হবে? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, তেমন কোনো সমস্যা হবে না। আমরা তো নতুন নিয়োগের সার্কুলার দিয়েছি।মাত্র দুই দিন আগে ২০ অক্টোবর চারঘাটে পুলিশ একাডেমিতে ৬২ জন সহকারী পুলিশ সুপারের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়। সব আয়োজন করার পরও এই কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবশ্য বলেছেন, অনিবার্য কারণে এই কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে। তবে কবে এই কুচকাওয়াজ হবে; তা তিনি বলেননি। তাদের ভাগ্যে কী আছে; তা জানার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ওই ৬২ জনকে ‘ছাত্রলীগের ক্যাডার’ উল্লেখ করে ওই অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেন। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কিছু কিছু ব্যাচের লম্বা সময় ধরে প্রশিক্ষণে রাখার ঘটনা আগেও হয়েছে অনেক সময়। কিংবা প্রশিক্ষণ চলাকালে বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে অনেকে বাদ পড়েছেন চাকরি থেকে। কিন্তু পুরো ব্যাচের কুচকাওয়াজ স্থগিতের ঘটনা সম্ভবত নজিরবিহীন ও একটু অস্বাভাবিক বলে মনে করেন সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলছেন, ঢালাওভাবে পুরো একটি ব্যাচের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ‘সুবিবেচনাপ্রসূত’ নয়। কেউ যদি রাজনৈতিক পরিচয় বা সুবিধা নিয়ে কোনো ফেভার পায়, কিংবা প্রশ্ন পেয়ে চাকরি পায়, সেটি যথাযথ তদন্তে প্রমাণিত হলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে একটি ব্যাচকে রাজনৈতিক তকমা দেয়াটা যৌক্তিক হতে পারে না। বিসিএসে চূড়ান্ত উত্তীর্ণের পর সহকারী পুলিশ সুপার কর্মকর্তারা সারদার পুলিশ একাডেমিতে মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। যার শেষ হয় সমাপনী কুচকাওয়াজে অংশ নেয়ার মাধ্যমে। এরপর তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেন। যেহেতু এই এএসপিদের কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছে; সেহেতু তাদের নিয়োগ ঝুলে গেল বলেই মনে হয়। পুলিশ প্রশাসনে নিয়োগ একটা লম্বা প্রক্রিয়া। বাছাই থেকে প্রশিক্ষণ শেষে কাজে যোগ দিতে তিন বছরের মতো সময় লাগে। সুতরাং নতুন সার্কুলারে লোক নিয়োগ দিলেও মাঝে শূন্যতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এই শূন্যতা যেন তৈরি না হয়; সেদিকে সংশ্লিষ্ট খেয়াল রাখবেন- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য