স্বৈরতান্ত্রিক সরকার বন্ধে আইনি ও কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে জোরালোভাবে। এই ভাবনাটা নতুন কিছু নয়। পরিবর্তনের একটি প্রস্তাবিত দিক—দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। তাত্ত্বিক রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আলম খান দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলেছিলেন অনেক আগে। জাসদ রাজনীতিও সেই ধারণাকেই ধারণ করে চলেছে। ওই সময় স্বল্প পরিসরে বিষয়টি রাজনৈতিক টেবিলে আলোচনায় এলেও খুব একটা জোরালো হয়নি। প্রথম সংবিধান প্রণেতাদের দল আওয়ামী লীগের অনেকেই বিরূপ সমালোচনা করলেও অনেকেই তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। সম্প্রতি জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। বিশেষজ্ঞগণ এ নিয়ে সোচ্চারও।
এমনিতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে স্থিতিশীলতা নেই। আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে যে সরকার গঠিত হবে সেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দলই পাবে না, সেখানে কেনা-বেচার খেলা চলবে এটা আগাম বলা যায়। এই কেনাবেচাকে সহজসাধ্য করে দেবে আরেকটি সাংবিধানিক ধারা। বলা হচ্ছে বর্তমান ৭০ ধারা বাতিল করা হবে। সেক্ষেত্রে সদস্যদের অতি স্বাধীনতা সরকারের স্থায়িত্বকে টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দেবে তা নিশ্চিত বলা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বৈরতন্ত্রের জন্য কি কাঠামোগত দিকটি দায়ী? আবার যারা মনে করেন, আমাদের সংবিধান এমনভাবে তৈরি যে, সরকার ইচ্ছা করলেই স্বৈরতন্ত্রকে বেছে নিতে পারে। বাস্তবতা এর সঙ্গে কতটা সাযুজ্যপূর্ণ? আসলে কাঠামোগত কিংবা সংবিধানের যতই পরিবর্তন আনা হোক না কেন, যদি কেউ আন্তরিকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চান তাহলেই সেটা সম্ভব, না হলে যতই বেড়াজাল দেওয়া হোক না কেন, স্বৈরাচার ঠেকানো সম্ভব নয়।
আমাদের এখানে সংবিধান স্থগিত করেও সরকার পরিচালিত হয়েছে। বিশেষ করে সামরিক সরকার চলাকালে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই তারা সংবিধানকে স্থগিত করে দিয়েছে। হয়তো বলা হবে, সামরিক শাসক গণতন্ত্রের আওতায় পড়ে না। কিংবা তারা গণতন্ত্র চর্চা করতেও ক্ষমতায় বসে না। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা বলে যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় বসে তারাও কি গণতন্ত্রকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে কিংবা চর্চা করে? তারা সামরিক সরকারের মতো সংবিধান স্থগিত করে না এবং তারা সংবিধানকে সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় আরোহন করে কিন্তু সংবিধানকে পাশে সরিয়ে রেখে নিজেরা একসময় স্বৈরতন্ত্রকে ধারণ করে।
যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হয় তবে বলতেই হবে, এটাই যেন এখানকার রাজনৈতিক রীতি। এই প্রমাণ তো আছেই। এমতাবস্থায় বলতে হবে, সংবিধান কখনো স্বৈরতন্ত্রকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। অর্থাৎ রাষ্ট্র স্বৈরতন্ত্রকে ধারণ করবে নাকি গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হবে তার প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে শাসকের মর্জির ওপর। ক্ষমতাসীনরা যদি সংবিধানের চেতনা বা স্পিরিটকে ধারণ না করেন, যদি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নামাবলি পরে অগণতান্ত্রিক হয়ে পড়েন, তাহলে তাকে ঠেকাবে কে?
একটু ভিন্নদিক আলোচনা করা যায়, সবক্ষেত্রেই রাষ্ট্র রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথাই বলা হয়ে থাকে। কাঠামোগত দিক কিংবা সাংবিধানিক দিক যাই বাস্তবায়নের কথা আসে সেটা করবে রাজনৈতিক দলগুলো। এই রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে যদি গণতন্ত্র অনুপস্থিত থাকে, তারা যদি গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র লালন করে, তাহলে তাদের দ্বারা স্বৈরতন্ত্র বাস্তবায়নের সম্ভাবনাই বেশি।
এখানে দল গঠনের প্রথাগুলো আলোচনায় আসতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর যে গঠনতন্ত্র থাকে তারা নিজেরাই সেটা অনুসরণ করে না। এমন দলও আছে বছরের পর বছর সাধারণ সভাই করে না। অথচ তাদের গঠনতন্ত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের কথা থাকে। কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা নির্বাচন হয় মুখ চিনে এবং বাকিদের মনোনীত করা হয় শীর্ষনেতার মুখের কথায়। আবার কেউ আছে যারা গঠনতান্ত্রিক নিয়ম রক্ষার্থে সাধারণ সভা করলেও সেখানে তাদের দলীয় শীর্ষ নেতাদের গঠনতান্ত্রিকভাবেই সেই অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয় যাতে তারা নিজেরা একনায়ক বনে যান।
সংস্কার কর্মসূচিকে সফল করতে হলে গোড়ায় হাত দিতে হবে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী হয়তো সরকার নতুন বিধি-বিধান তৈরি করবে। হয়তো রাজনৈতিকভাবে দলগুলো তৃপ্তিবোধও করতে পারে। কিন্তু নিজেদের ঘরের ভিতর কতটা গণতন্ত্র আছে সেদিকে খবর রাখে না। তাই বড় সংস্কারের আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রথম নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার উদাহরণ তৈরি করতে হবে। তারা যে নিজেরা একনায়ক নয় সেটা প্রমাণ করতে না পারলে স্বৈরতন্ত্র হটানোর যত চেষ্টাই করা হোক না কেন স্বৈরতন্ত্র ফিরে ফিরে আসবেই।
রাজনৈতিক দলগুলো একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করছে কি না তা দেখার সুযোগ নেই আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। যদি জিজ্ঞেস করা হয় তখন জবাব আসবে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৃণমূলের কাছে জবাবদিহি করতে পারে। এটা একবারেই ডাহা মিথ্যা। বাস্তবতা হচ্ছে এখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে প্রধান যা বলবেন সেটাই তৃণমূলের কথা, কিংবা বলা চলে তৃণমূলের কোনো ক্ষমতা এখানে নেই হাত তোলা ছাড়া।
তারপরও আলোচনা-পর্যালোচনা থেমে নেই। বিশেষ করে অন্তবর্তীকালীন সরকার সংস্কার কমিশন গঠনের পর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে আলোচনা ব্যাপকতর হয়েছে। স্বৈরশাসন প্রতিরোধে অনেক বিজ্ঞজনই আনুপাতিক নির্বাচন করার পক্ষে সুপারিশ করছেন। আনুপাতিক নির্বাচন বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা কেউ দেননি। কিন্তু আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি কি সরকারকে স্বৈরতান্ত্রিক হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবে?
এই পদ্ধতিতে সরকার গঠন করলে বাংলাদেশে সরকারগুলো তাদের মেয়াদ পূরণ করার আগেই ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা আছে। যদিও বলা হয়ে থাকে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে অধিকাংশ ভোটারের মতামতের প্রতিফলন ঘটে না। ভোটসংখ্যায় সংখ্যালঘু হওয়ার পরও সরকার গঠন করছে এখন। এতে করে অধিকাংশ ভোটার উপেক্ষিত হয়ে থাকে। কিন্তু আনুপাতিক ভোটপ্রাপ্তির ভিত্তিতে সদস্য নির্বাচিত হলে কি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রতিফলিত হবে?
চারটি দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আর সেখানে সর্বাধিক একক প্রার্থী যদি অন্য প্রার্থীর সম্মিলিত ভোটের চেয়ে কম পেয়ে থাকেন তাতেও তাকে সুযোগ দান থেকে বিরত রাখা হবে? দ্বিতীয় হওয়া প্রার্থী অন্য এলাকার ভোটের যুক্ত হওয়ার সুযোগে কি সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাবেন? যদিও আনুপাতিক হারে সদস্য বাছাই ক্ষেত্রে আঞ্চলিক প্রার্থীর জনপ্রিয়তাকে উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু আসন বন্টনকালে আন্তঃদলীয় মতানৈক্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। তাই বাংলাদেশের মতো দেশে আনুপাতিক ভোটপ্রাপ্তির সুবাদে সংসদ গঠনের চিন্তা কতটা বাস্তবসম্মত হবে তা ভেবে দেখার বিষয় আছে।
সংস্কার চিন্তায় রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা লক্ষ্য করার মতো। সাধারণত যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারলেও তৃণমূলে তাদের জনভিত্তি না থাকার কারণে কখনো নির্বাচিত হতে পারে না, সেইসব ক্ষুদ্র দলগুলো জোরালোভাবে আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে সদস্য মনোনয়ন ও নির্বাচনের কথা বলে থাকে। বড় দলগুলো, বিশেষ করে সম্প্রতি বিএনপিও প্রচলিত পদ্ধতিতেই থাকার কথা বলছে। ছোট দলগুলো ক্ষমতার স্বাদ পেতে নির্বাচনী পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার পক্ষে মত দিয়ে থাকে।
এসব প্রসঙ্গকে সামনে রেখেই হয়তো সংস্কার কমিশন কাজ করবেন। নতুন কিছু যোগ করার আগে তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, মানুষের মন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বিবেচনা করবে। তা না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য