-->

পেশাদার ক্যাডার পরিবর্তনে সমস্যা

ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান
পেশাদার ক্যাডার পরিবর্তনে সমস্যা

বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো একটি জটিল ও বিস্তৃত ব্যবস্থা, যেখানে ২৬টি ক্যাডারের আওতায় বিভিন্ন ধরনের ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা কাজ করেন। প্রধানত ক্যাডারগুলোকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়: পেশাদার বা কারিগরি ক্যাডার এবং সাধারণ প্রশাসনিক বা জেনারেলিস্ট ক্যাডার। পেশাদার ক্যাডারগুলো সাধারণত ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ইত্যাদি বিশেষজ্ঞ পেশার কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত, যেখানে জেনারেলিস্ট ক্যাডার কর্মকর্তারা সাধারণ প্রশাসন এবং নীতি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। লোক-প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় উভয় ধরনের সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পেশাদার ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের মূল কর্মক্ষেত্র ছেড়ে প্রশাসনিক কাজে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।

বাংলাদেশে পেশাদার ক্যাডার কর্মকর্তারা যখন তাদের কর্মজীবন প্রযুক্তিগত সেবার (যেমন - প্রকৌশল, চিকিৎসা, কৃষি) থেকে সাধারণ প্রশাসন বা প্রশাসনিক ক্যাডারে পরিবর্তন করেন, তখন তা রাষ্ট্রের জন্য বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। এ ধরনের স্থানান্তর কেবল ব্যক্তি কর্মকর্তার দক্ষতার অপচয় নয়, বরং পুরো সিস্টেমের স্থিতিশীলতা, সেবা প্রদান এবং উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এখন দেখা যাক এর ফলে মোটাদাগে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কী কী ক্ষতি হতে পারে।

অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার অপব্যয়: একজন পেশাদার ক্যাডার কর্মকর্তা সাধারণত তার শিক্ষাজীবনে এবং কর্মজীবনে দীর্ঘ সময় ধরে নির্দিষ্ট একটি কারিগরি খাতে দক্ষতা অর্জন করেন। পেশাদার / টেকনিক্যাল কর্মকর্তারা তাদের শিক্ষাজীবনের বড় একটি অংশ ব্যয় করেন বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জনে। কিন্তু যখন তারা সাধারণ প্রশাসনে স্থানান্তরিত হন, তখন সেই বিশেষ দক্ষতা আর সরাসরি কাজে আসে না। উদাহরণস্বরূপ, একজন চিকিৎসক যখন প্রশাসনিক দায়িত্বে যান, তখন তিনি স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নমূলক কাজ যেমন - হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যনীতির বাস্তবায়ন ইত্যাদি থেকে দূরে চলে যান। এর ফলে স্বাস্থ্যসেবা খাতে তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা ব্যাহত হয় এবং সেই খাতের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। স্বাস্থ্য খাতে এমন একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকা মানে সেই খাতের দায়িত্ব কম অভিজ্ঞ কেউ গ্রহণ করছেন, যা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় এবং জনগণের জন্য অপর্যাপ্ত সেবা সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।

বিশেষায়িত খাতগুলোর দক্ষতা ও গুণগত মানের হ্রাস: কারিগরি খাত, যেমন - স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রকৌশল, পরিবেশ বিজ্ঞান এবং শিক্ষা অত্যন্ত বিশেষায়িত এবং গভীর জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এই খাতগুলোতে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের নীতিনির্ধারণী পরামর্শ প্রদান এবং বাস্তবায়ন পর্যায়ে থাকতে হয়। কিন্তু যখন এই কর্মকর্তারা সাধারণ প্রশাসনে চলে যান, সেই খাতগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন - একজন উচ্চপদস্থ কৃষিবিদ যখন সাধারণ প্রশাসনিক ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হন, তখন কৃষি উন্নয়নের নানা কার্যক্রম, যেমন - বীজ উন্নয়ন, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ বা কৃষি প্রযুক্তির প্রসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো সঠিক নেতৃত্বের অভাবে ধীরগতিতে চলে। কৃষিতে বিশেষজ্ঞদের অভাব হলে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ে।

নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে শ্লথগতি এবং অযোগ্য নেতৃত্ব: কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা তাদের খাতে কার্যকর নীতি নির্ধারণে পরামর্শ প্রদান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একজন পেশাদার কর্মকর্তা যে খাতের মধ্যে কাজ করছেন, তিনি সেই খাতের সমস্যা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন। যখন তারা বিশেষায়িত কাজ ফেলে প্রশাসনিক কাজ করে তখন সেই খাতে অভিজ্ঞতার অভাবে নতুন কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ পদ্মা সেতু বা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, অত্যন্ত কারিগরি দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। যদি প্রকৌশলীদের একটি বড় অংশ সাধারণ প্রশাসনের দিকে আগ্রহী হতে থাকেন তবে এই ধরনের প্রকল্পগুলোতে নেতৃত্বের অভাব দেখা দেবে।

প্রশিক্ষণ এবং মানবসম্পদের অপচয়: একজন পেশাদার ক্যাডার কর্মকর্তাকে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং তার দক্ষতা বিকাশের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদের বড় একটি অংশ ব্যয় করা হয়। সর্বোপরি, একজন প্রকৌশলী বা ডাক্তারকে তৈরি করার জন্য প্রচুর সরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। যখন এই কর্মকর্তারা সাধারণ প্রশাসনে চলে যান, তাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা রাষ্ট্রের সেই খাতে আর কাজে আসে না, ফলে প্রশিক্ষণের জন্য করা বিনিয়োগের অপচয় ঘটে। যেমন - চিকিৎসকদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে যে ব্যয় হয়, তা স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্যই ব্যয় করা হয়। কিন্তু সেই চিকিৎসক যদি প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত হন, তবে তার চিকিৎসা প্রশিক্ষণ সেই কাজে সরাসরি কোনও ভূমিকা রাখে না। এটি স্পষ্টতই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অপচয় এবং দক্ষ জনবল ব্যবহারে অসঙ্গতি সৃষ্টি করে।

দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় ধারাবাহিকতার ক্ষতি: পেশাদার ক্যাডার কর্মকর্তারা সাধারণত তাদের খাতের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত থাকেন। তারা কোনও একটি নির্দিষ্ট খাতে অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে সেই খাতের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও গবেষণার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হন। কিন্তু যখন তারা প্রশাসনে স্থানান্তরিত হন, তখন তাদের ছেড়ে যাওয়া দায়িত্বে নতুন কেউ আসেন, যিনি হয়তো সেই একই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নিয়ে আসতে পারেন না। এর ফলে, সেই প্রকল্পের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয় এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অত্যন্ত কারিগরি জ্ঞাননির্ভর। বিদ্যুৎ খাতের প্রকৌশলীদের যদি প্রশাসনিক কাজে স্থানান্তরিত করা হয়, তবে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন প্রকল্পের ধারাবাহিকতা ও সঠিক বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

পেশাগত অসন্তোষ এবং মেধার অপচয়: পেশাদার কর্মকর্তারা অনেক সময় ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য প্রশাসনে কর্মজীবন গড়ে তুলতে আগ্রহী হন। এটি পেশাদার ক্যাডারদের মধ্যে একটি “ইৎধরহ উৎধরহ” বা মেধা পাচারের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে দক্ষ জনবল তাদের মূল কাজ ছেড়ে অন্যান্য কাজে নিয়োজিত হয়। এটি শুধু তাদের ব্যক্তিগত মেধার অপচয় নয়, বরং রাষ্ট্রেরও ক্ষতি।

পেশাদার ক্যাডার কর্মকর্তাদের কারিগরি সেবা থেকে সাধারণ প্রশাসনে যাওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এটি দক্ষতা, মেধা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ঘটাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে পেশাদার কর্মকর্তাদের তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে উপযুক্ত পেশাগত সম্মান, সুযোগ-সুবিধা এবং প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও কারিগরি সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সাধারণজ্ঞদের পাশাপাশি পেশাদারদের সঠিকভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: লোক-প্রশাসন এবং জননীতি গবেষক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version