বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জন্মদিন আজ। ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরোনো ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন এই মহান বীরমুক্তিযোদ্ধা। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলায়, বাবার নাম মৌলভী আবদুস সামাদ, আর মায়ের সৈয়দা মোবারকুন্নেসা।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট করাচির মশরুর বিমানঘাঁটিতে শিক্ষার্থী মিনহাজ রশীদের কাছ থেকে টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান করায়ত্তে নিয়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এ সময় ভারতীয় সীমান্তের ৩৫ মাইল দূরে থাট্টায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে মিনহাজ রশীদের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই মতিউর একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটি হঠাৎ বিকল হয়ে যায়। কিন্তু অপূর্ব দক্ষতায় প্যারাস্যুটযোগে মাটিতে অবতরণ করেন তিনি। এ সময় ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে যে বিমান মহড়ার আয়োজন করা হয়, তাতে তিনিই একমাত্র বাঙালি পাইলট ছিলেন।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। ১৯৬৩ সালে রিসালপুর পিএএফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। কমিশনপ্রাপ্তির পর তিনি করাচির মৌরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ার বেজের ২ নম্বর স্কোয়াড্রনে জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি টি-৩৩ জেট বিমানের ওপর কনভার্সন কোর্স সম্পন্ন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে মতিউরের অসম সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ জাতীয় খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিউর রহমান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে ছিলেন।
প্রায় ৩৫ বছর পাকিস্তানের ওই কবরেই শায়িত ছিলেন বাংলাদেশের এই বীরশ্রেষ্ঠ। ২০০৬ সালের ২৩ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পুনরায় তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫ জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বাংলাদেশের একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা ও অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়, তিনি তাদের অন্যতম।
৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ। তার বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
মতিউর রহমান ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে রিসালপুর পিএএফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। কমিশন প্রাপ্তির পর তিনি করাচির মৌরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ারবেজের ২ নম্বর স্কোয়াড্রনে জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি টি-৩৩ জেট বিমানের ওপর কনভার্সন কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ৭৫.৬৬% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি এফ-৮৬ স্যাবর জেটের ওপর কনভার্সন কোর্স করেন এবং ৮১% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। বৈমানিক কনভার্সন কোর্সে ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে তাকে পেশোয়ারে (১৯ নম্বর স্কোয়াড্রন) পোস্টিং দেয়া হয়।
১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটি হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাস্যুটযোগে মাটিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দু'বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭০-এ বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে।
১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর রহমান সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে আসেন। ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি ছিলেন নরসিংদীর রায়পুরার রামনগর গ্রামে। যুদ্ধ শুরু হলে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন। যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন। তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ বাহিনী। পাক-সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইপিআরের সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এফ-৮৬ স্যাবর জেট থেকে তাদের ঘাঁটির উপর বোমা বর্ষণ করে। মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন, তাই ঘাঁটি পরিবর্তন করেন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তার বাহিনী।
এরপর ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকায় আসেন ও ৯ মে পরিবার নিয়ে করাচি ফিরে যান। কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল এবং সেটি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাকে তখন বিমানের সেফটি অফিসারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। তিনি বিমান দখলের জন্য ২১ বছর বয়সী রাশেদ মিনহাজ নামে একজন শিক্ষানবীশ পাইলটের উড্ডয়নের দিন (২০ আগস্ট, ১৯৭১) টার্গেট করেন। তার পরিকল্পনা ছিলো মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেলে তিনি তার কাছ থেকে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নেবেন। পরিকল্পনা অনুসারে অফিস থেকে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে। সামনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমানটি-৩৩। পাইলট রাশেদ মিনহাজ বিমানটি নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো একক উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কন্ট্রোল টাওয়ারের ক্লিয়ারেন্সের পর মিনহাজ বিমানটি নিয়ে রানওয়েতে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে মতিউর রহমান সেফটি অফিসারের ক্ষমতা বলে বিমানটি থামাতে বলেন। মিনহাজ বিমানটি থামান এবং ক্যানোপি খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান। এ সময় মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর আগে রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল রুমে জানাতে সক্ষম হন যে তিনি সহ বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে। বিমানটি ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার মিনহাজের বার্তা শুনতে পায় এবং রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও মতিউর রহমান বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডারকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসার চেষ্টা করেন।
প্রায় ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া অবস্থায় রাশেদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করেন। রাশেদ চাইছিলেন, মতিউর রহমানের বিমান ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সফল হওয়ার চেয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত করা ভালো। এ সময় রাশেদের সাথে মতিউরের ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রাশেদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। বিমানটি কম উচ্চতায় উড্ডয়ন করার ফলে এক সময় রাশেদসহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমানের সাথে প্যারাসুট না থাকায় তিনি নিহত হন। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়।
২০ আগস্ট, ১৯৭১-এ মতিউর রহমান এবং রাশেদ মিনহাজ স্বস্বদেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ সরকার মতিউর রহমানকে তার সাহসী ভূমিকার জন্য বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে এবং রাশেদ মিনহাজকে পাকিস্তান সরকার সম্মানসূচক খেতাব প্রদান করে। প্রসঙ্গত, একই ঘটনায় দুই বিপরীত ভূমিকার জন্য দুইজনকে তাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক খেতাব প্রদানের এমন ঘটনা বিরল।
শাহাদতের ৩৫ বছর পর, ২৪ জুন ২০০৬, মতিউরের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে দেশে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুনঃসমাহিত করা হয়। পাকিস্তান সরকার মতিউর রহমানের মৃতদেহ করাচির মাসরুর ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে সমাহিত করেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫ জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়।
লেখক: প্রভাষক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য