শৈশব প্রতিটি শিশুর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আনন্দময় শৈশব অত্যন্ত জরুরি। আর আনন্দময় শৈশবের জন্য উন্মুক্ত খেলার মাঠ, সামাজিক কাঠামো, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পারিবারিক সহাবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে শৈশব সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি দেশে শিশুর শৈশব আজ নানা কারণে বিপন্ন। সেভ দ্য চিলড্রেন-এর ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন শিশু তার শৈশব হারিয়ে ফেলেছে। বিপন্ন শৈশবের কারণে শিশুরা অল্প বয়সে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং তাদের আচরণে বিচ্যুতির প্রভাব লক্ষণীয়। বিপন্ন শৈশবের জন্য প্রধানত দায়ী প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অপব্যবহার। প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে শিশুর শৈশব এবং সৃজনশীলতা, তাকে করেছে চার দেয়ালে বন্দি।
১৯২০ সালে টমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন, মোশন পিকচার আসার কারণে টেক্সট বই উঠে যাবে, সবাই মোশন পিকচারের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত পেয়ে যাবে। আজ ১০০ বছর পর এসে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে টমাস আলভা এডিসনের কথার প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ২০১৯ সালের করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। টেলিভিশন, রেডিও-এর পরিবর্তে এখন মানুষের নজর বেশি থাকে ফেসবুক, টিকটক, গুগল, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট, ভাইবার, উইচ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপের ওপর। বর্তমান বিশ্বে সোশ্যাল মিডিয়া যোগাযোগ ও বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে জনপ্রিয় হলেও দেশের যুব সমাজের কাছে এর আবেদন সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২০ জন ছাত্রছাত্রীদের উপর পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, কোভিড-১৯-এর কারণে যুব সমাজের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে ৪০% শিক্ষার্থী ফেসবুক বা টিকটকের ওপর আসক্ত।
বিশ্বজুড়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর একটি বড় অংশেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। আর বাংলাদেশে এই হার আরও বেশি। মজার বিষয় হলো বাংলাদেশে প্রতি ১২ সেকেন্ডে ১ জন করে ফেসবুক ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছে; যা দেশের জন্মহারের চেয়ে বেশি। এই একটি তথ্য বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় দেশের তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর কতটা আসক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি, এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম। যার মধ্যে বেশিরভাগই ছাত্রছাত্রী এবং বয়স ১১ থেকে ৩০ বছর।
অন্য একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী দিনে প্রায় ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট মোবাইল স্ক্রিনে সময় ব্যয় করে এবং প্রয়োজন ব্যতিরেকে ১৮৫ বার তার মুঠোফোন লগইন করে। হয়তোবা এইজন্যই প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়’। সংক্রামক ব্যাধির মতোই আজ অপসংস্কৃতি আর অসামাজিক কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়ালজুড়ে। প্রকৃতপক্ষে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক টোবিয়াস ডিয়েনলিন বলেন, আপনি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারেন; কিন্তু দিন শেষে আপনার জীবনে তার প্রভাব কতটা সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যতক্ষণ না এটি আপনার জীবনে সমস্যা তৈরি না করবে, ততক্ষণ আপনি বুঝতে পারবেন না যে, আপনি আসক্ত হয়ে পড়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জালে।
কিন্তু শিশুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তির জন্য শুধু কি তারা নিজেরাই দায়ী, নাকি অভিভাবক, পারিবারিক কাঠামো, প্রযুক্তির সহজলভ্যতাও সমভাবে দায়ী? এর পাশাপাশি আর যে বিষয়টি দায়ী তা হলো পুশ ফ্যাক্টর এবং পুল ফ্যাক্টর। যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আকর্ষণীয় ফিচার আমাদের আকৃষ্ট করে তখন তা পুল ফ্যাক্টর। আর পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ যখন আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে উৎসাহিত করে তখন সেটি পুশ ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া অত্যধিক জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো পুশ ফ্যাক্টর। কোভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। সেই সময়ে ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যক্রমের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য অনলাইন ভিত্তিক পাঠদানের কার্যক্রম শুরু করে। ফলে অভিভাবকরা সন্তানদের স্মার্টফোন দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা বাধ্য হয়ে পড়েন। ছাত্রছাত্রীদের স্মার্টফোন কি শুধু পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? ছাত্রছাত্রীরা একাডেমিক ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রধান বাহন হিসেবে মোবাইল ফোনের ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে। একসময় সেই নির্ভরশীলতা আসক্তিতে রূপান্তরিত হয়। মোল্লা ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপে উঠে এসেছে, কোভিড-১৯ কালীন সময়ে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্তার শিকার হয়েছেন কিংবা এর ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আমাদের সমাজে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তারিকুল আলম বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যথেচ্ছ ব্যবহার ব্যক্তি জীবনের উদ্বেগ, পারিবারিক জীবনে অশান্তি, বিষণ্নতার জন্য দায়ী। তিনি আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে কিশোর-কিশোরীর শারীরিকের চেয়ে মানসিক ক্ষতি বেশি হয়। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব পাবলিক হেলথ-এ প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, যে সকল কিশোর-কিশোরী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বেশি সময় ব্যয় করে, তাদের ঘুমের মান অনেক খারাপ, একাগ্রতা হ্রাস এবং পরবর্তীতে একাডেমিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া ও তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা অনেকটা কমে যায়। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি শিশু মোবাইল ফোনে ২ মিনিট কথা বললে তার মস্তিষ্কে যে কম্পনের সৃষ্টি হয় তা স্থির হতে ৯০ মিনিট সময় লাগে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, এখানে কোনো ব্যবহারকারী স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেই মতামত অন্যের ক্ষতি করতে পারে তা আমাদের শিশুদের বোধগম্য নয়। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ইউনিসেফের গবেষণায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০-১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার মতো বিপদে রয়েছে। ‘বাংলাদেশের শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা’ শিরোনামে ইউনিসেফ কর্তৃক পরিচালিত অপর একটি সমীক্ষায় দেশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার ১২৮১ জন শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়, যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে শারীরিক অথবা মানসিক হেনস্তার শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ১০ শতাংশ শিশু কিশোর ধর্মীয় উস্কানির কথাও বলেছেন। ইউনিসেফ বাংলাদেশের সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু ১১ বছরের আগেই ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করে। এছাড়া শিশুদের একটি অংশ, যা প্রায় ৬৩ শতাংশ, ইন্টারনেট ব্যবহারের জায়গা হিসেবে নিজেদের কক্ষকে ব্যবহার করে; যা ‘বেডরুম কালচার’-এর ব্যাপকতা নির্দেশ করে।
সম্প্রতি চীনের গবেষকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অধিক ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করেছেন। চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর ১৬৭ জন শিক্ষার্থীদের উপর সেই জরিপ পরিচালিত হয়। তারা দাবি করেছেন যারা একটানা ৩ দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বন্ধ রাখেন তাদের ফিরে আসার সম্ভাবনা কম থাকে। গবেষকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকার জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন—পরিবারকে সময় দেওয়া, কাজের সময় মোবাইলের নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা, বই পড়ার অভ্যাস করা, ডায়েরি লেখা। প্রযুক্তি জায়ান্ট ও মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস-এর মতো আমরাও আমাদের সন্তানদেরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অধিক ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট হবো।
লেখক: ব্যাংকার ও সমাজকর্মী।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য