জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের মায়া-মমতা বাড়ছে না। বরং মানুষ দিনদিন আরও হিংস্র হয়ে উঠছে। বেশ কিছুদিন ধরে মানুষ পিটিয়ে হত্যার ঘটনা বেড়েছে। তুচ্ছ ঘটনায় একজন আরেকজনকে হত্যা করছে। শুধু তা-ই নয়; সেই হত্যাকাণ্ডকে উৎসবে পরিণত করছে তারা। চট্টগ্রামে গানের তালে তালে নেচে নেচে যুবককে পিটিয়ে হত্যার কথা কি আমরা ভুলে গেছি? না, ভুলিনি। হয়তো আমরা একটা সময় ভুলে যাব আরও শত ঘটনার ভিড়ে। কিন্তু তার স্বজনরা মনে রাখবে সারাজীবন। একজন মানুষকে বেঁধে আরও কয়েকজন পিটিয়ে হত্যা করল! উৎসব করল! এটা আসলে ভুলে যাওয়ার ঘটনা না। ঘটনাটি ১৩ আগস্ট রাতের। চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন দুই নম্বর গেট আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের নিচে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ‘মধু হই হই আঁরে বিষ খাওয়াইলা, কোন কারণে ভালোবাসার দাম ন দিলা’ গানটি গেয়ে যুবককে পেটানো হয়। ওই যুবকের নাম শাহাদাত হোসেন। তাকে কী কারণে হত্যা করা হলো, তা জানা যায়নি। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ঘটনার বিচার হবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
নড়াইলের তুলারামপুর এলাকায় গরুচোর সন্দেহে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার ভোররাতে নড়াইল-ঢাকা-বেনাপোল মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী জানান, তুলারামপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গরু চুরির ঘটনা ঘটছে। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার ভোরে ওই এলাকার তরফদার বখতিয়ার হোসেন হান্নানের বাড়িতে তিনজন গরু চুরি করতে যান। কুকুরের ডাকে বাড়ির মালিক বিষয়টি টের পেয়ে চিৎকার করেন। তাদের চিৎকারে গ্রামবাসী চোরদের ধাওয়া করে পিটুনি দিলে তিনজন নিহত হন। তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোনে কথা বলে গ্রামের লোকজন জানতে পারেন, দুজনের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জে। ২৬ অক্টোবর রাতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমবাড়িয়া ইউনিয়নের নতুন সুতাইল গ্রামে চোর সন্দেহে জাহাঙ্গীর নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। ১৮ অক্টোবর রাত ১টার দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার লালানগর গ্রামে ফিরোজ খান নামে এক যুবলীগ নেতাকে বোনের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯ অক্টোবর পরীক্ষা দিতে গিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের এক নেতা মারধরের শিকার হয়েছেন। রবীন্দ্র-নজরুল কলা ভবনের গগন হরকরা গ্যালারির কক্ষে পরীক্ষা চলার সময় এ ঘটনা ঘটে। গত সেপ্টেম্বরে দেশে গণপিটুনির ৩৬ ঘটনায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত করা হয়েছে আরও ১৪ জনকে। একই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন, আহত হয়েছেন অন্তত ৭০৬ জন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এই তথ্য জানিয়েছে। সংগঠনটি বলছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছু বিষয়ে উন্নতি ঘটলেও সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে। সেপ্টেম্বরে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেপ্তার, সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, শ্রমিক হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি নির্যাতন ও হত্যা এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত আছে।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার কথা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম মোল্লাকে হত্যার কথাও মনে নেই! ১৮ সেপ্টেম্বরের ওই দুই হত্যাকাণ্ডে সারাদেশে নিন্দা, ক্ষোভ আর প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। সেই ঝড় থেমেও গেছে। এই ঝড় থামা আর ওঠার মধ্য দিয়েই আমরা চলছি। চলতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় হলো মানুষ গড়ার কারখানা। সেখানে যারা মানুষ হত্যা করছে, তাদের কী বলা যায়? অমানুষ? না, অমানুষ বলাও ঠিক হবে না। তাহলে তাদের... বলা যায় বৈকি! আসলে মানুষের মধ্যে প্রতিহিংসা প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। মানুষ মারতে তাদের হাত কাঁপছে না। তুচ্ছ ঘটনায়ও মানুষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে দ্বিধা করছে না। ঘুরে ফিরে একটা কথাই বার বার মনে পড়ছে— ‘আবার তোরা মানুষ হ।’
লেখক: সাংবাদিক।
মন্তব্য