আমার ভাগ্নে আতাউর রহমান বাবুল থাকে নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আলবানিতে। সে খুব রাজনৈতিক সচেতন এবং সামাজিক মাধ্যমে দারুণভাবে সক্রিয়। তার ফেসবুক হলো একটা ছোট্ট বাংলাদেশ- যেখানে সুদূর সন্দ্বীপ থেকে লস এঞ্জেলেসের বাংলাদেশিদের অবাধ বিচরণ।
দুদিন আগে বাবুলের ফোন পেলাম, ‘মামা, মসজিদের ইমামরা সব বলছেন কমলা হ্যারিসকে ভোট না দিতে। অনেক বাংলাদেশি- মার্কিন ভোটার তাদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন।’
আমি বললাম, ‘ইমাম সাহেবদের কথা মেনে কাউকে ভোট দিতে হবে বা বয়কট করতে হবে এমনতো কোনো কারণ নেই। ভোট দিবে নিজের যুক্তি ও পার্টি সমর্থনের ভিত্তিতে।’
ইমাম সাহেবদের অনেকে মনে করেন রাষ্ট্রপ্রধান মহিলা হওয়া জায়েজ নয়। অনেকে আবার ফিলিস্তিনের উপর হামলায় বাইডে- মলার সমর্থনের প্রতিবাদে কমলাকে ভোট দেওয়ার বিরোধী। এর বিকল্প যে খুব সুখকর নয়, তা তারা ভেবে দেখেননি।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি মহলে সর্বত্রই এই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঙালির আড্ডার কেন্দ্রগুলো- জ্যাকসন হাইটস, ম্যাকডোনাল্ড চার্লস, ব্রনক্সের স্টার্লিং এবং লস এঞ্জেলেসের লিটল বাংলাদেশ সবখানে বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনা আপাতত স্থগিত, সবার আলোচনা কমলা হ্যারিস নাকি ডনাল্ড ট্রাম্প?
ব্রনক্সের স্টার্লিং কেন্দ্রে বাজার করতে গেলাম ছুটির দিনে। এক গ্রোসারি দোকানে আবু তাহের নামের এক ভদ্রলোক আমাকে সবসময় সাহায্য করেন। বাঙালি দোকানগুলোতে গেলেই বেশ দেশি-দেশি আত্মীয়তা অনুভব করি। দোকানের লোকজন কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলাপচারিতা করেন পরিচিতের মতো। যদিও মাঝে মাঝে কিছু কথা-বার্তা খুব ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায়। কিছু নমুনা দিচ্ছি : ‘স্যার কি কাম করেন?’ ‘বেতন কেমন ফান?’ ‘বাংলাদেশে বাড়ি কোন জাগায়?’ পোলা মাইয়া কিতা করে?’ ‘বাংলাদেশের যে অবস্থা, হাসিনারে তো গুতায়ে ভাগাইয়া দিছে। ইনুস সাব পাইরবোনি? দুই বছর ধইরা এদেশে। এখনো কাগজটা কইরতে ফাইরলাম না।’ ‘এইবার আমনে ভোট দিবেন কারে?’
ব্যক্তিগত প্রশ্নেও আমি তেমন কিছু মনে করি না, এরা খুব সরল মনে কথা বলে। আমি কিছু উত্তর দিই, কিছু কৌশলে এড়িয়ে যাই। আমি তাহের মিয়াকে একটু পরীক্ষা করার জন্য বললাম, ‘এখনো ভাই ঠিক করিনি কাকে ভোট দেব। আপনি বলুন কাকে দিলে ভালো হবে ?’
‘ট্রাম্প, ট্রাম্প। হেরে দিয়া দেন। বাইডেন বোমা মাইরা মুসলমানদের অর্ধেক শেষ কইরা দিচ্ছে। কমলা আইলে বাকিটাও শেষ অইয়া যাইব।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। জানি না তাহের মিয়া অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে ট্রাম্পের বিষোদ্গার সম্বন্ধে জানেন কিনা অথবা ট্রাম্পের ইসরায়েল পলিসি সম্বন্ধে?
বাজারে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে ভালো লাগে। চায়ের দোকানে গিয়ে আমি চা খাই, দেখি লোকজন দলবেঁধে আড্ডা দিচ্ছেন আর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন। দারুণ উত্তাপ অনুভব করি।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসীদের উৎসাহ প্রধানত অন্য দুইটা বিষয় নিয়ে:(১) অবৈধ অভিবাসীদেরকে নিয়ে কে কি বলছেন(২) মুসলমানদের পক্ষে-বিপক্ষে কোনো প্রার্থীর কি মনোভাব। ট্রাম্প জিনিসপত্রে কত আমদানি কর বাড়াবেন বা ইউক্রেইনের যুদ্ধ কেন বন্ধ করে দিবেন আর কমলা স্বাস্থ্য খাতে আরো কি কি সাশ্রয় দিবেন- বেশির ভাগ প্রবাসীর এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই।
প্রবাসীদের উৎসাহের প্রথম বিষয়ে, ডেমোক্র্যাটরা খুব উদার। মূলত কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসীদের ভোটেই তারা সবসময় ক্ষমতায় এসেছে এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে। দ্বিতীয় বিষয়ে একতরফা কারো পক্ষে রায় দেওয়া যাবে না। আমি আলাপচারিতার মধ্যে কোনো কোনো বাংলাদেশি বন্ধুদের বলতে শুনেছি, ভোট দিব কমলাকে। কমলা মেয়ে মানুষ, প্রেসিডেন্ট হলে এত যুদ্ধ বিগ্রহ ও মানুষ হত্যা চাইবেন না।
আবার অনেকে বলেছেন, ট্রাম্পই ভালো হবে। কমলাদের মতো যুদ্ধ ও খুনাখুনি পছন্দ করেন না। তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে সব মীমাংসা করে দিবেন।
যে যেভাবেই বলুন না কেন, আসলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের মধ্যে মুসলমানদের বন্ধু খুবই নগন্য। এখানে রাজনীতিবিদদের সমর্থন পেতে হলে, আপনাকে ওদের পেছনে অনেক টাকা ঢালতে হবে। সিনেট, কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ওদের অনেক টাকার প্রয়োজন। ইহুদীরা দলবেঁধে মার্কিন রাজনীতিবিদদেরকে হাজার মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। বিনিময়ে ইসরায়েল পাচ্ছে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার এবং অকৃপণ মার্কিন সমর্থন। টাকা-কড়ির ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশিরা এমনিতেই বেশ রুগ্ণ, আমাদের মার্কিন আরব ভাইয়েরাও ইহুদীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছে না।
আমরা যারা এক ক্লাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান পড়েছি তাদের একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ আছে। এই গ্রুপের অনেক সদস্য এখন দেশ বিদেশের শীর্ষ জ্ঞানজীবী। আমি আমার লেখাগুলো মাঝে-মাঝে এই গ্রুপের সঙ্গে শেয়ার করি। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত আমার পূর্ববর্তী লেখাটা নিয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। যেমন- আমার মনে হয়, কিছু মুসলিম কমিউনিটি তার মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। তারা মনে হয় শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পকেই নির্বাচিত করে ছাড়বেন।’
‘আমেরিকাতে কখনো একজন মহিলা প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। মনে হয়, কমলার জন্য এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। মার্কিনিরা মহিলাদেরকে খুব কমই বড় রাজনৈতিক নেতৃত্বে দেখেছে, যার জন্য মহিলা নেতৃত্বের পক্ষে মতামত নিতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত। মহিলারা স্কুল মাস্টার, নার্স বা সেক্রেটারি হবেন, এটাই যেন স্বাভাবিক।’
প্রবাসী যারা উচ্চশিক্ষিত তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে সাধারণের চিন্তার কিছুটা পার্থক্য থাকবেই। সাধারণরা খুব সাধারণভাবেই চিন্তা করেন । যতই ভোট কাছে আসছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাইডেন ও কমলার উপর ক্রোধ আরো বাড়ছে। ইসরায়েলও গাজা ছাড়িয়ে এখন লেবানন, সিরিয়া ও ইরানে হামলা করছে, বাড়াচ্ছে তাদের রক্তের তৃষ্ণা। বাংলাদেশি ও মুসলমান প্রবাসীদের কমলাকে ভোট না দেওয়ার প্রত্যয়ও বেশ বাড়ছে। অনেক প্রবাসী কমলা বা ট্রাম্পকে ভোট না দিয়ে ভোটের দিন বাড়িতে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। প্রবাসীদের জন্য এটা বেশ জটিল- একদিকে মুসলমান বিদ্বেষী ট্রাম্প এবং অন্যদিকে ‘জেনোসাইড’ বাইডেনের ডান হাত কমলা।
নির্বাচনের মাত্র চার দিন বাকি থাকতে ডনাল্ড ট্রাম্প (৩১ অক্টোবর) এক এক্স পোস্টে লিখেছেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
তিনি আরো লিখেছেন, আমার প্রশাসনের সময় আমরা ভারত ও আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর অংশীদারত্ব আরও জোরদার করব।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভালো বন্ধু হলেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচিত হলে তিনি ও মোদি বাংলাদেশ নীতিতে একসঙ্গে কাজ করবেন তা ধরেই নেওয়া যায়। এটা বাংলাদেশে যারাই সরকারে থাকুন না কেন তাদের ওপর চাপ বাড়াবে।
ট্রাম্প এত বড় বড় দেশ রেখে বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটা দেশ নিয়ে নির্বাচনের আগে কথা বলেছেন তা খুব আশ্চর্যজনক। কেউ বলবেন, যুক্তরাষ্ট্রের হিন্দু ভোটারদের পক্ষে টানার জন্য, কেউ বা বলবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডেমোক্র্যাটদের ভালো বন্ধু, তাকে কোনঠাসা করার জন্য।
কারণ যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের উত্তেজনাকর কথাবার্তা ড. ইউনূসের জন্য খুব ভালো খবর নয়। অবশ্য কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এসব কথার কোনো প্রভাব থাকবে না।
বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের নতুন কথাবার্তায় বাংলাদেশি প্রবাসীদের ভোটে কি কোনো পরিবর্তন আসবে? খুব সম্ভবত না। যারা ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন, তারা ট্রাম্পের মোদি-ঘেঁষা নীতি আগে-ভাগেই জানেন।
আর একটা জিনিস না বললেই নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মূলত যে চারটি অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা- নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা ও টেক্সাস। এই অঙ্গরাজ্যগুলোতে বলা যায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হবে না। নিউ ইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া নীল, মূলত ডেমোক্র্যাটদের। অপরদিকে ফ্লোরিডা ও টেক্সাস হলো লাল, পুরোপুরি রিপাবলিকানদের দখলে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি প্রবাসী ভোটারের সংখ্যা খুবই নগণ্য এবং এই প্রবাসীরা মূলত যে চার অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা সেগুলোর কোনোটার ভোটেই তেমন প্রভাব ফেলতে পারবেন না তা আগেভাগেই বলে দেওয়া যায়। তবুও প্রবাসীরা তাদের ভোট দেওয়া বা না দেওয়ার মাধ্যমে তাদের আকাঙ্খা ও আক্রোশ মেটাবেন, এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। বাংলাদেশেও এই সৌন্দর্যচর্চার জন্য অপেক্ষা করে থাকব আমরা।
লেখক: শিক্ষক, সৌদি আরব ফাহাদ কিং বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য