বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন দিবস আজ সোমবার। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর প্রণীত হয় এই সংবিধান। আর একই বছর ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় এটি। গত ৫২ বছরে নানা প্রেক্ষাপটে ১৭ বার কাটাছেঁড়া করা হয়েছে এই সংবিধান। তবে সংবিধানে বারবার সংশোধনী আনার পর অনেক বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে চারবার। শুধু একটি সংসদে, অর্থাৎ ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেয়াদের সপ্তম সংসদে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংবিধান নিয়ে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। সংসদ ভেঙে দেওয়া, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, রাষ্ট্রপতি অপসারণসহ নানা বিষয়ে দেখা দিয়েছে সাংবিধানিক জটিলতা। এর প্রেক্ষাপটে সংবিধান সংস্কারের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। কেউ বলছেন সংবিধান পুনর্লিখনের কথা, কেউ বলছেন প্রয়োজনীয় সংশোধনের কথা। পরে রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন গঠনের সঙ্গে সংবিধান সংস্কারেও অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিশন গঠন করেছে। সংস্কারের অংশ হিসেবে কমিশন গতকাল সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা যেমন প্রবর্তন করা হয়েছিল, অন্যদিকে দুবার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমেই। গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে বিজয়ের পর ৯০-এর দশকের শুরুতে দেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদে সংবিধানের এই সংশোধনী পাস হয়েছিল। নির্বাচনি ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক সরকারের বদলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। আবার পরে পাল্টা সংশোধনী এনে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের (সংসদ) যাত্রা শুরু হয়েছিল। গণপরিষদে সংবিধান বিল গৃহীত হয়েছিল ৪ নভেম্বর। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে কার্যকর হয়েছিল সংবিধান। বলা হয়ে থাকে, এত অল্প সময়ে আর কোনো দেশে সংবিধান প্রণয়নের নজির নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণপরিষদের সদস্য এবং রাজনীতিকদের নিয়ে ৩৪ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল। আট মাসের মধ্যেই কমিটি সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিল।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, বর্তমান সংবিধান ১৯৭১-এর পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল। এরপর নানা প্রেক্ষাপটে সংবিধান বারবার সংশোধন হয়েছে। তবে বর্তমানে যে সংকট দেখা দিয়েছে, এটা সংশোধনীর মাধ্যমেই সমাধান করা যায়। তবে বাতিলের দিকে গেলে দশ-বিশ বছর পরে তা আবারও বাতিল হতে পারে।
সংবিধানের ১৭ সংশোধনী: সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল পাস হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। প্রথম সংশোধনীটি ছিল যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। একই বছর ২০ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বিল পাস হয়। এতে সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদে (২৬, ৬৩, ৭২ ও ১৪২) সংশোধন আনা হয়। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিরাক্রমণে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার বিধান চালু করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা নির্ধারণী একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় বিধান প্রণয়ন করা হয়।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়। সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন এই সংশোধনীর মূল কথা। জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডকে বৈধতা দানসহ সংবিধানে এর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করা হয়। সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয় ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই সময়ে বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদে তাদের প্রার্থী হিসেবে আবদুস সাত্তারকে মনোনয়ন দেয়। ষষ্ঠ সংশোধনীতে সেই পথটাই নিশ্চিত করা হয়।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন বহাল ছিল। ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে এরশাদের ওই সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া হয়। ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী আনা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদে (২, ৩, ৫, ৩০ ও ১০০) পরিবর্তন আনা হয়। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতিদান করা ও ঢাকার বাইরে ৬টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করার বিধান চালু করা হয়। তবে পরবর্তীকালে ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠনের বিষয়টি বাতিল করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। নবম সংশোধনী আনা হয় ১৯৮৯ সালের ১০ জুলাই।
এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিকে নিয়ে কিছু বিধান সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর আগে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি যতবার ইচ্ছা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচন করতে পারতেন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের সঙ্গে একই সময়ে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ব্যক্তির পরপর দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
দশম সংশোধনী বিলটি পাস হয় ১৯৯০ সালের ১২ জুন। রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(২) অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষ্য সংশোধন ও সংসদে নারীদের ৩০টি আসন আরও ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ করার বিধান করা হয়।
গণ অভ্যুত্থানে এইচ এম এরশাদের পতনের পর বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে ১৯৯১ সালে ৬ আগস্ট একাদশ সংশোধনী পাস হয়। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উপ-রাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়।
১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ এয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। আইন বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী জমির উদ্দিন সরকার এই সংশোধনীটি উত্থাপন করেন। উচ্চ আদালতের আদেশে ২০১১ সালে এই সংশোধনীটি বাতিল হয়। চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয় ২০০৪ সালের ১৬ মে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী আসন ৩০ থেকে ৪৫টি করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং সরকারি ও আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি বা ছবি প্রদর্শনের বিধান করা হয়।
২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়। এই সংশোধনীর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বিদ্যমান ৪৫-এর স্থলে ৫০ করা হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। ৭২-এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিধান পাস করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। উচ্চ আদালতের রায়ে এই সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখার প্রস্তাব সংবলিত সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হয়।
সংবিধান দিবসের কর্মসূচি: দেশের সংবিধান প্রণয়নের এই দিনটি (৪ নভেম্বর) দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মাত্র দুবারই জাতীয় দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হয়েছে। ২০২২ সালে দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এরপর ২০২৩ সালেও যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। তবে এবার অন্তর্বর্তী সরকার দিবসটিকে জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। তবে প্রতি বছরের মতো এবারও দিবসটি পালন করবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি।
আজ বিকাল ৪টায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেনকে প্রধান অতিথি করে এক আলোচনা সভা আয়োজন করেছে সংগঠনটি।
লেখক: সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য