বিদেশ বিভূঁইয়ে চাকরির সুযোগ হওয়ায় বাংলাদেশের বেকার সমস্যা যে অনেকাংশে নিরসন হয়েছে, সেকথা জোর দিয়েই বলা যায়। আর বিদেশে গিয়ে চাকরি করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে এমন মানুষের সংখ্যাও আমাদের দেশে কম নয়। বলা চলে, বাংলাদেশের বেকার জনগোষ্ঠীর বিদেশে চাকরি করার সুযোগ হওয়ায় বদলে গেছে বাংলাদেশ। তবে বিদেশের শ্রম বাজারে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের চাহিদা দিনদিনই বাড়ছে। গতকাল দৈনিক ভোরের আকাশে প্রকাশিত খবরে সেকথাই বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রবাসে দক্ষ শ্রমিকদের কপাল খুলছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ৫ লাখেরও বেশি শ্রমিক বিদেশে চাকরি হয়েছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক শুধু সৌদি আরবেই কাজ পেয়েছেন। এই দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা মেটাতে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করার কোনো বিকল্প আছে বলে আমরা মনে করি না। দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারলে বাংলাদেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়বে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ (বিএমইটি) ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান চলতি বছর বেড়েছে। ২০২২ সালে বিদেশে দক্ষ কর্মী গিয়েছিল ২.৫২ লাখ, চলতি বছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩.০৮ লাখ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশ থেকে স্বল্প-দক্ষ কর্মী অভিবাসনের হার গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ২৩ শতাংশ কমে ৬.২৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ রেকর্ড ১২ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে দক্ষ কর্মী অভিবাসনের হার ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ এবং অদক্ষ শ্রমিক প্রায় ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান চলতি বছর ২২ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০২২ সালে বিদেশে দক্ষ কর্মী গিয়েছিল ২.৫২ লাখ, চলতি বছর সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩.০৮ লাখ। এ বছর প্রায় ২.৬১ লাখ আধা-দক্ষ কর্মী বিদেশে গেছেন, যেখানে ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৪২ হাজার ৭৭১ জন। এ বছর চিকিৎসক, নার্স, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি বিশেষজ্ঞসহ ৫০ হাজার ১৫৮ জন পেশাদারও কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন, আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬৪০ জন। কর্মী নিয়োগকারীদের তথ্যমতে, কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে বেশি বিদেশে যায় ড্রাইভার, কেয়ারগিভার, গৃহকর্মী, আতিথেয়তা কর্মী, ইলেকট্রিশিয়ান, কোয়ালিটি কন্ট্রোল সুপারভাইজার; রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনার, প্লাম্বিং ও পাইপ ফিটিং এবং সাধারণ বৈদ্যুতিক কর্মী।
আশার কথা হচ্ছে যে দেশে দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে বহু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তন্মধ্যে বিএমইটির অধীনে ১১০টির মধ্যে ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পুরোদমে চালু থাকলেও প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা মোট শ্রম অভিবাসীদের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি নয়। বিভিন্ন অংশীজন, বিশেষ করে সরকার তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৯ লাখ ৩০ হাজার ৩ কর্মীকে চাকরি দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছে। গত নয় মাসে বিদেশ যাওয়া মোট ৯ লাখ ৩০ হাজার ৩ জন শ্রমিকের মধ্যে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ২২৫ জন পুরুষ এবং ৭১ হাজার ৭৭৮ জন মহিলা। পাশাপাশি, চলতি বছরে বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা গত অক্টোবর মাসে ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছে, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে বিদেশে যাওয়া কর্মীরা ১ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা আগের অর্থবছরের একই সময়ে পাঠানো ৬ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে ৮ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। তাই বিদেশে পাঠানো কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের অধিকার এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক দেশে নার্স, ডাক্তার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। তাই এসব ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে বিদেশি চাকরির বাজার দখলে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ তাদের চাহিদাভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি বিকাশে বিনিয়োগেরও পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তাদের এই পরামর্শকে কাজে লাগাতে হবে।
আমরা মনে করি, আমাদের এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে সরকার উদ্যোগ নিবে। ইতোমধ্যেই দক্ষ চাকরিপ্রার্থী তৈরির জন্য সরকার দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বৈদেশিক কর্মসংস্থানকেও উৎসাহিত করেছে সরকার। আমরা আশা করবো, বিদেশের শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সরকার জোরালো উদ্যোগ নিবে, আর সেটাই আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য