-->

ঢিলের রাজনীতি ও রাজনীতির ঢিল

একটি সাদাসিধা পর্যবেক্ষণ

ড. শ্যামল দাস
ঢিলের রাজনীতি ও রাজনীতির ঢিল

শুরু থেকেই বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক দর্শনটি বোঝার চেষ্টা করেছি। অনুমানও করেছিলাম ঠিক কী হতে যাচ্ছে। যদিও তারা রাজনৈতিক দর্শন প্রকাশে মোটেও সময় নেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই সাহসী উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ সরকারের দর্শন এবং ক্ষমতায়নের রাজনৈতিক লক্ষ্যটি আমাদের সামনে তুলে ধরেন প্রায়ই। তাদের বক্তব্য অবশ্যই সাধারণ মানুষের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বের মূল সারিতে তারাই ছিলেন।

তাদের সাথে অবশ্য ড. ইউনূস ও তার বিশেষ সহকারী জনাব মাহফুজকেও মাঝে-মধ্যে দেখা যায়। তবে মাহফুজ অনেক সময়ই ‘মাস্টারমাইন্ড’ খেতাবের কারণেই হয়তো কিছুটা দুর্বোধ্য; সে তুলনায় নাহিদ এবং আসিফ সহজবোধ্য।

আমরা দেখলাম, আচমকাই নাহিদ এবং আসিফ একই দিনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুটি মন্তব্য করেছেন যার উদ্দেশ্য ছিল, (আমার মতে) তাদের রাজনৈতিক দর্শন প্রচারের তৃতীয় ঢিল। এর আগে দুটো ঢিল তারা ছুঁড়েছেন এবং বোঝার চেষ্টা করেছেন, মানুষ কীভাবে এবং কতটা হজম করে সেগুলো। যেকোনো নতুন বা বিপরীত ধারার মতাদর্শের প্রচার এভাবেই করা হয়; বর্তমান ক্ষেত্রে আদর্শটি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে ক্ষমতার পরিমণ্ডল থেকে।

আমি মনে করি, প্রথম ঢিলটি ছিল জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনবিষয়ক। এই ঢিলটি গোলাম আযমের ছেলে আজমী ছুঁড়েছিলেন। যদিও এই সরকারের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি মনে করি এটি আসলে ক্ষমতার বর্তমান রাজনৈতিক দর্শনের সমর্থক একটি প্রভাবশালী অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে। সবাই মিলে দেখতে চেয়েছেন এই ঢিলের কারণে মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। একেবারে মাঠে মারা না গেলেও এ ঢিলটি বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ হজম করেনি। সম্ভবত, তারা এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। ফলে কয়েকদিন অপেক্ষা করে এই রাজনৈতিক ক্যাম্পটিকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হয়েছে, এই দাবির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি বিষয় নয়; বিষয় হলো, আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষ এই ক্যাম্পে জড়ো হয়েছে কিনা সেটা বোঝা। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এ সংখ্যাটি শঙ্কিত হওয়ার মতো না হলেও এরা এখন নিজেদের মত প্রকাশে অনেক বেশি সাহসী মনে হয়েছে।

সফল গণঅভ্যুত্থানটি যেন তাদের এই সাহসের বৈধতা দিয়ে গেছে। যদিও এখন তারা যা বলছে কিংবা করার উদ্যোগ নিচ্ছে সেগুলোর কোনোটিই আন্দোলনের স্লোগানে কিংবা মেনিফেস্টোতে ছিল না। বোঝা যাচ্ছে, ঢিলটি একবারে লক্ষ্য ছুঁতে না পারলেও লক্ষ্যের কাছাকাছি বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে এসেছে।

দ্বিতীয় ঢিলটি ছিল আরও অনেক বড় পরিসরে। অনেক বেশি শক্ত জায়গা থেকে ছোড়া। এটিকে আমরা এখন ‘রিসেট বাটন’ ঢিল নামে ডাকি। এই ঢিলটি এসেছিল স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে। ভয়েস অব আমেরিকার সাথে ইন্টারভিউয়ের সময় তাকে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ভাস্কর্য অবমাননা সম্পর্কে তার সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে। তিনি এর সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘আপনি পুরনো দিনের কথাবার্তা বলছেন। এরমধ্যে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেছে আপনার মনে হয় স্বরণে নেই। আপনি এমনভাবে কথা বলছেন, যেন এসব ঘটনা ঘটেই নাই। কাজেই নতুন ভঙ্গিতে যা হচ্ছে, এটা দেখতে হবে তো। কত ছেলে প্রাণ দিল সেটা নিয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন নেই। কেন প্রাণ দিল। কাজেই ওগুলো আসুক। তারপরে... প্রথম স্বীকার করতে হবে যে তারা বলেছে, ছাত্ররা বলেছে যে আমরা রিসেট বাটন পুশ করেছি। এভরিথিং ইজ গন।’

বিষয়টি কী দাঁড়ালো তবে? বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ একটি পুরনো বিষয় কিংবা অতীত? যদিও পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এর একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের অনেক মানুষ প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যটি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি বলে আমার ধারণা। এমনকি বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও এ ব্যাপারে তাকে সরাসরি সমর্থন জানাননি। মনে রাখতে হবে, বিএনপি ঘরানার রাজনীতিতে স্বাধীনতা যুদ্ধে জেনারেল জিয়ার একটি বড় অবদানের কথা ইতিহাস স্বীকৃত, যদিও আওয়ামী লীগ তা মানতে চায় না, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সঠিক মূল্যায়ন না করলে জিয়াউর রহমানের অবদানও মূল্যায়িত হয় না; বঙ্গবন্ধুর পর আরও অনেকের সঙ্গে তিনিও আলোচনায় আসেন আমাদের ইতিহাসে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যই।

আমার মনে একটি বড় প্রশ্ন জেগেছিল আগেই। সেটি হলো এই যে, বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত যারা, তারা যা যা বলছেন বা করছেন সেসবের ম্যান্ডেট কি আন্দোলনটি তাদের দিয়েছিল? কোটাবিরোধী এই আন্দোলনটির শুরুর দিন ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুর বিরাট প্রতিকৃতি বহন করেছিল।

আন্দোলনের মূল যে উদ্দেশ্য সেটি পূরণ হওয়ার পথে সরকারের একগুঁয়েমি ও নৃশংস দমন নীতির কারণে এক দফা দাবিতে এটি সফল হয় এবং শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। মূলত তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে- এটাই ছিল পরের অংশে আন্দোলনের লক্ষ্য। এই আন্দোলনের কোনো পর্যায়েই এটি বলা হয়নি যে, আন্দোলনটি স্বাধীনতার স্থপতি বা আমাদের জাতির জনকের বিরুদ্ধে, কিংবা আমাদের স্বাধীনতার তুলনায় সদ্য যে আন্দোলনটি চলছিল সেটি অনেক বড় অথবা এটি আমাদের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হতে যাচ্ছে।

অন্য কথায়, আমাদের স্বাধীনতার ন্যারেটিভ পাল্টানো হবে এমন কোনও বক্তব্য বা ইঙ্গিত কোথাও আমরা দেখিনি। আমরা দেখতে পাই যে, এ আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টিসহ তেরোটি বামপন্থি দল অংশ নিয়েছে, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে বর্তমান বক্তব্যগুলোর উল্টো ধারণা পোষণ করে। আমার বিশ্বাস, আন্দোলনের নেতারা সে সময় তাদের মূল এজেন্ডাটি প্রকাশ করলে আন্দোলনের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হতো।

আসলে যদিও এগুলো অন্দোলনের সময় মানুষকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশে তখন বলা হয়নি এবং জাতির পিতা বা ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ অথবা ৭ মার্চের বিরুদ্ধে কোনো প্রকাশ্য এজেন্ডা তাদের ছিল না, আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে অনেক কার্যক্রম দেখে আমাদের কাছে এটি মনে হচ্ছিলো যে, আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দর্শনটি স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের যে ভূমিকার কথা আমরা জানি সেটিকে মুছে নতুন একটি রাজনৈতিক ন্যারেটিভ জাতিকে দিতে চাইছে। এটি ছিল আন্দোলনের ‘হিডেন এজেন্ডা’। যেমনটি সব রাজনৈতিক আন্দোলনের মাঝেই থাকে।

প্রকাশ্যে স্বাধীনতার প্রচলিত ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে বলার মতো অবস্থা সদ্য বিগত আন্দোলনের আগে তো নয়ই, এটি চলার সময়ও কোনও পর্যায়েই ছিল না। নেতৃত্ব থাকার কারও ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়েও কোনো বক্তব্য ছিল না; সেই আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে বর্তমান সময়ের বক্তব্য বলে দিচ্ছে, এটিই হয়তো তাদের মাথায় ছিল।

প্রশ্ন হলো, আন্দোলনে যদি এসব এজেন্ডা নাই থেকে থাকে, তবে এগুলো এখন বাস্তবায়নের কথা বললে সেটি কতটা বৈধতা পেতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রচলিত ন্যারেটিভে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা প্রচুর। দ্বিতীয়ত, এই বিশ্বাসীদের একটি অংশ সদ্য বিগত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন; তাদের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু বা তৎকালীন আওয়ামী লীগের অবদান সম্পর্কে বর্তমান শাসকদের অবস্থান কতটা বৈধতা পাবে?

তৃতীয়ত বঙ্গবন্ধু ‘জাতির জনক কোনোভাবেই হতে পারেন না’ এমন মন্তব্যের স্বপক্ষে বক্তারা কি প্রামানিক দলিল উপস্থাপন করেছেন? আমার এটি জানা নেই। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে অনেকের অবদান আছে; এটি সত্যি। কিন্তু তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে হলে বঙ্গবন্ধুকে তার আসন থেকে নামাতে হবে- এই মানসিকতার কী কারণ? আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর মানুষটি এ পৃথিবীতে নেই; তবুও তার ওপর এত রাগ কেন?

পৃথিবীতে সবকিছু নিয়েই রাজনীতি হয়। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামই শেখ মুজিব; এই রাজনীতিতে একটি কেন্দ্রীয় দিন ৭ মার্চ; একটি কেন্দ্রীয় আসন ‘জাতির জনক’; এ জাতির একটি কেন্দ্রীয় দুঃখের দিন জনকের প্রয়ান দিবস। এগুলোকে যারা মানতে চান না তারাই স্বাধীনতার সব প্রতিষ্ঠিত সত্য নিয়ে বিতর্ক করেন। এ প্রবণতা বাংলাদেশে নতুন নয়, আগেও দেখা গেছে।

গান্ধীর মৃত্যুদিনকে ভারত ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে; জিন্নাহ’র মৃত্যুদিন পাকিস্তানে সরকারি ছুটি থাকে। কাজেই বাংলাদেশে জাতির জনকের প্রয়ান দিবস পালন কেন কারো কারো এত গায়ে জ্বালানো ব্যাপার তা বোধগম্য নয়। কবি নির্মলেন্দু গুনের কবিতার লাইন মনে পড়ে, ‘মুজিব মানে আর কিছু না; মুজিব মানে মুক্তি; পিতার সঙ্গে সন্তানের ওই না-লেখা প্রেম চুক্তি।’

সবচেয়ে বড় কথা এসব করার ম্যান্ডেট তারা কোথায় পেলো? এখন পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত যা যা করা হচ্ছে, তার কোনো কিছুরই ম্যান্ডেট তাদের নেই। একারণেই যে, এগুলো সদ্য সফল আন্দোলনের কোনো পর্যায়েই দাবি করা হয়নি বা আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবেও বলা হয়নি। এসব কাজ করতে কেউই বলেনি।

ঐতিহাসিক সত্য এই যে, শেখ মুজিব বাঙালি জাতিকে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশে একতাবদ্ধ করেছিলেন এবং এই কারণেই এ রাষ্ট্রের তিনি জনক। ইতিহাস বলে, বাঙালি জাতিকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রকাশ্য রাজনৈতিক স্বপ্ন ছিল কেবল তারই, অন্য কারোর নয়, তিনিই জনগণকে সেই স্বপ্নে বিভোর করতে পেরেছিলেন। জনগণের কাছে তিনিই প্রকৃত ও প্রায়োগিক অর্থে এ ধারণাটি প্রকাশ করেছিলেন বা তার রাজনৈতিক আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এটি অনেকগুলো অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যে গন্তব্য সেটিতে পৌঁছেছিলেন।

হামুদুর রহমান কমিশনের যে রিপোর্ট তার সংক্ষিপ্ত সার কী বলে? নিয়াজী বা ফরমান আলী কিংবা খাদিম হোসেন রাজা কী বলেন? সাম্প্রতিক অতীতে তাঁদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। খুঁজে দেখা যেতে পারে তারা কী বলেছেন মুজিব সম্পর্কে। হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে লেখা ইয়াহিয়ার চিঠিই বা কী বলে? বারোজন পাকিস্তানি জেনারেলের স্মৃতিচারণমূলক বই আছে; তাদের সাক্ষাৎকার আছে; তারা মুজিব ছাড়া আর কার কার নাম বলেছেন একই কাতারে সেটি খুঁজে দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গভীর পঠন পাঠন এ জাতির সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের বোধকে শানিত করে। প্রায়ই আমরা এটি করি না। আমাদের জানা দরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতির জনকের স্থানটি কীভাবে নির্ধারিত হয়। যেমন, পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আজম জিন্নাহকে কীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল অথবা ভারতে গান্ধী কেন জাতির জনক। পাকিস্তান সৃষ্টিতে অনেক মনিষীর অবদান আছে, কিন্তু কেউই এ রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা ইকবালকে জাতির জনক বলেননি; অথবা জিন্নাহ বা মুসলিমলীগ বিরোধী কেউ কখনও বলেননি, জিন্নাহর মতো পাকিস্তানের আরও অনেক ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ আছেন; কাজেই জিন্নাহকে জাতির জনকের স্থান থেকে ফেলে দিতে হবে। এর সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে যে, ফাউন্ডেশনের কাজে অনেকেই যুক্ত থাকেন, কিন্তু সবাই ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বা ‘ফাদার অব নেশান’ও হন না।

মুজিবের সংগ্রামী ইতিহাসের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জাতির জনকদের ইতিহাস পাঠ করলেই বোঝা যাবে কেন মুজিব জাতির জনক হিসেবে শুধু বাংলাদেশে নয়, এ পৃথিবীতেই অনন্য। ইতিহাসে যেসব বিষয় স্থাপিত হয়ে গেছে সেসব বিষয়কে বিতর্কিত করার মতো বক্তব্য দেওয়ার সময় আরও ইতিহাস পাঠ জরুরি, গভীর বিশ্লেষণ জরুরি। যেমন ধরা যাক, ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো সেরা ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ ঘোষণা করেছে। তাদের ‘দ্য মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’ নামের সংকলনে সেটির উল্টো অবস্থান নিতে গেলে সে ধরনের তথ্য উপাত্ত দেওয়া প্রয়োজন।

ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে নিয়ে অযথা বিতর্ক উস্কে দিয়ে কী লাভ হচ্ছে জানি না। শেখ মুজিব এখনও এ দেশের সাংবিধানিক জাতির জনক এবং বর্তমান সরকারের সবাই সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। ইতিহাস বলে, ৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তারা কাকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল; কার বিচার করেছিল দেশদ্রোহীতার অভিযোগে; সারা পৃথিবীর সংবাদপত্রগুলো কাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা মেনেছিল?

মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অনেকে চেষ্টা করেন মুজিবের সমান্তরালে ভাবতে। অথচ জিয়া নামের মানুষটি নিজে কখনও এমন দাবি করেননি; বঙ্গবন্ধুকে একবারের জন্যও সরাসরি অসম্মানিত করেননি জিয়া। জিয়াউর রহমান ১৯৭৪ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। তিনি সে লেখার একটি অংশে সাতই মার্চের কথা বলেন এভাবে, ‘তারপর এলো মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারা দেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন’। জিয়ার মতোই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা স্বীকার করে নিয়েছেন সকল সেক্টর কমান্ডাররা; তৎকালীন প্রবাসী সরকারটি চলেছে তার নামে। বাংলাদেশ নামের দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার কারণে; তিনিই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এ দেশ স্বাধীন করার কথা বলেছেন; ছয় দফা দিয়ে একটি জাতির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন; এই ছয় দফা এবং পরবর্তীতে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছেন। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভুট্টো কারুর কাছে মাথা নোয়াননি। পাকিস্তানের কারাগারে ভুট্টোর প্রস্তাব ফিরিয় দিয়েছেন; ইয়াহিয়ার সমঝোতার প্রস্তাব ঘৃণনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এসব কেবলমাত্র মুজিবের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

শেষ কথা হলো এই যে, আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার সোল এজেন্ট তৈরি করি আমরাই। দেখা যায়, যতবারই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে ততবারই নতুন ক্ষমতাসীনদের মূল আক্রমণের শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু এবং তার সঙ্গে বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের ফলে এটি বারবারই প্রমাণিত হয় যে, আওয়ামী লীগের নামের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম জড়িয়ে গেছে; অথচ ক্ষমতায় থেকে এ কাজটি না করলে হয়ত বা ইতিহাসের নিয়মেই সবার ভূমিকার পুনর্মূল্যায়ণ ঘটতো। সে সঙ্গে এটিও মনে রাখা দরকার যে, স্বৈরাচার হটানো সম্ভব, কিন্তু নতুন ক্ষমতার বলয়ে আদর্শিক ফ্যাসিজম বাদ দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। কাজেই সাধু সাবধান!

লেখক: অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, এলিজাবেথ সিটি স্টেট ইউনিভার্সিটি (নর্থ ক্যারোলিনা)।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version