মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় সব বুথফেরত সমীক্ষাতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ব্যালট বক্স খুলতেই দেখা গেল উল্টোপুরাণ। প্রথম থেকেই এগিয়ে যায় রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। চরম নাটকীয়তায় আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হয়ে নানা রেকর্ড ও মাইলফলকের জন্ম দিয়েছেন তিনি। রাজনীতির ময়দানে বর্ণময় এক চরিত্র হিসেবে বিশ্বনেতাদের পাশে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখালেন তিনি।
গোটা পশ্চিমা বিশ্বে অতি ডান নীতি বাকচতুরতাকে রাজনীতির মূল মঞ্চে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে বার্তা দিলেন বিশ্বমঞ্চে তার উপযোগিতা এখনো ফুরায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের লড়াই নিতান্ত রূপকথার চেয়ে কম কিছু নয়। ভোটের আগে একপ্রকার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল ট্রাম্পের। নির্বাচনে জিতে আসতে না পারলে হয়তো জেলের ঘানি টানতে হতো। মোটা অঙ্কের আর্থিক জরিমানা তো হতোই। শেষ পর্যন্ত অনবদ্য প্রত্যাবর্তনে সেই সম্ভাবনা কাটিয়ে ‘সিনবাদ’ হয়ে গেলেন ট্রাম্প।
এবারের ভোটে তাই একটু বেশিই মরিয়া মনে হচ্ছিল ট্রাম্পকে। সেই অতি ডানপন্থা, খানিক উগ্রতা, খানিক আগ্রাসন মিশিয়ে মার্কিন জনতার সামনে দেবদূত হয়েছেন তিনি। অভিবাসন নীতি থেকে শুরু করে গর্ভপাত, এমনকি সীমান্ত সমস্যা সব ইস্যুতেই আগ্রাসী প্রচার চালিয়েছেন তিনি। কখনো অভিবাসীদের ‘আবর্জনা’ বলে দেওয়া, কখনো ‘মেক্সিকো সীমান্ত বন্ধ’ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। ভোটের প্রচারে কোনো রকম লুকোচুরি করেননি। যার সুফল মিলেছে এই নির্বাচনে। একেবারে খাদের কিনারে থেকে নির্বাচনে জিতে আসা ট্রাম্প যেন এখন আরও অনেক বেপরোয়া, আরও অনেক শক্তিশালী।
এবারের নির্বাচনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার বড় একটি ফ্যাক্টর ছিল। তাইতো মার্কিন অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে তিনি স্লোগান তৈরি করে রেখেছেন ‘আমেরিকাকে আবার শ্রেষ্ঠ করব’। যা টনিকের মতো কাজও করেছে। ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া অনেকটা সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশু’র নাট্যমঞ্চে প্রত্যাবর্তনের গল্পের সঙ্গে মিলে যায়। প্রাক নির্বাচনি পর্বের যাবতীয় নাটক সাঙ্গ হওয়ার পর এবার যেন ‘দাশু’র মতোই প্রত্যাবর্তন হলো ট্রাম্পের।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ায় বাংলাদেশ খুব বিপদে পড়ছে বলে এমন একটি বিমূর্ত ধারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। বিষয়টা এমন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ায় আমাদের দেশের অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়বে। আসলে কি তাই?
বলা হয়, মার্কিন সাম্রাজ্যে নেতা বদলায় কিন্তু নীতি বদলায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কিন্তু রাতারাতি পরিবর্তন হয় না। তাদের পররাষ্ট্রনীতি আগামী একশ বছরকে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট এসে যে তাদের পররাষ্ট্রনীতি রাতারাতি পরিবর্তন করবে এমনটি ভাবা অর্থহীন।
ট্রাম্প পুরোদস্তুর একজন ব্যবসায়ী। তিনি চাইবেন যেকোনো মূল্যে ব্যবসা করতে। যুদ্ধ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন চরম অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সময় পার করছে। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। হঠাৎ করে নতুন প্রেসিডেন্ট এই বলয়ের বাইরে গিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবে এমনটি ভাবাও বোকামি। এবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের জায়গাগুলো কী তা নিরূপণ করা যাক:
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের বড় জায়গা হলো তৈরি পোশাক। কেননা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের একক বৃহত্তম ক্রেতা। চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক প্রস্তুতকারক। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অর্থনীতির চাকাও।
অন্যদিকে, করোনাকালীন সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যে বাংলাদেশ করোনা প্রতিরোধে নতুন তৈরি পোশাক পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস ইত্যাদি রপ্তানি শুরু করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে। যা ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কের উন্নয়নে বড় একটি ফ্যাক্টর হবে।
২. বাংলাদেশে প্রধান আমেরিকান রপ্তানি দ্রব্য হলো কৃষিজ দ্রব্য (সয়াবিন, তুলা, ভুট্টা, দুগ্ধজাত দ্রব্য), এয়ারক্রাফট, মেশিনারি, ইঞ্জিন, লোহা ও স্টিল সামগ্রী। বাংলাদেশ থেকে প্রধান আমদানি দ্রব্য হলো পোশাক, ফুটওয়্যার, বস্ত্র, খেলনা, গেম ও খেলার সামগ্রী, গলদা ও বাগদা চিংড়ি এবং কৃষিজ দ্রব্য। অপার সম্ভাবনার দুয়ার খোলা রাখছে এসব বাণিজ্যে। সুদূরসম্প্রসারী মাস্টার প্ল্যান করতে হবে এসব বাস্তবায়নের জন্য।
৩. বাংলাদেশ থেকে একক দেশ হিসেবে রপ্তানিকৃত পণ্যের শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও (এফডিআই) সবচেয়ে বেশি আসছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই অর্থনীতির দেশ থেকে। তাই সম্পর্ক ধরে রাখতে আমাদের খুব কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।
৪. বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্স প্রবাহের পর যে দেশটির নাম শীর্ষে উঠে আসবে তার নাম যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৮৯৩ কোটি ৭১ লাখ ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ১৪১ কোটি ৮২ লাখ ডলার, যা এ সময় মোট রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় ১৬ শতাংশ।
বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে আসে। অর্থনীতির জন্য যা একটি বিশাল খাত। যদি ট্রাম্প রেমিট্যান্সের ওপর ট্যাক্স আরোপ করে তবে তা আমাদের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে। এজন্য ভিন্ন চিন্তা মাথায় রাখতে হবে।
৫. বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রথম রোড শোর আয়োজন করে। পর্যায়ক্রমে তা হয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি, লসএ্যাঞ্জেলেস ও সানফ্রানসিসকোতে। যার ভালো অর্থনৈতিক সুফল তখন আমরা পেয়েছি। এই বিষয়ে আরও কীভাবে কাজ করা যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
৬. আমেরিকার বৃহত্তর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের মাধ্যমে। যা মূলত বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের মাধ্যমে হয়। তথ্য বলছে, জাতীয় গ্রিডে স্থানীয়ভাবে সরবরাহকৃত গ্যাসের প্রায় ৩৪ শতাংশই আসছে মার্কিন এই কোম্পানি পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে এই বিষয়গুলো কীভাবে মাথায় রেখে কাজ করা যায় তা ভাবতে হবে।
৭. বাংলাদেশে ২০১৩ সালের জুন মাসে সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কা আসে। আশা করছি নতুন সরকার এ ব্যাপারে আরও অনেক বেশি মনোযোগী হবে।
৮. ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট (টিকফা) চুক্তির ধারাগুলো আরও বেশ শক্তিশালী করতে হবে। যাতে উভয় দেশ বাণিজ্যে লাভবান হয়।
৯. প্রকৃত অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে কম। এটা ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু একটি দলের ওপর নির্ভর করে না। এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক, কৌশলগত, ভূ-রাজনৈতিকসহ অনেক বিষয় জড়িয়ে আছে। শুধু প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হয়ে গেলেই যে দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বদল হয়ে যায় এমনটিও নয়।
বাংলাদেশ থেকে একক দেশ হিসেবে রপ্তানিকৃত পণ্যের শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও (এফডিআই) সবচেয়ে বেশি আসছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই অর্থনীতির দেশ থেকে। তাই সম্পর্ক ধরে রাখতে আমাদের খুব কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।
সামরিক দিক থেকেও বাংলাদেশ একটি উদীয়মান দেশ। সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রির অন্যতম ক্রেতা আমরা হতে পারি। এতে করে মার্কিনিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কমবে না বরং বাড়বে। বাংলাদেশকে ‘উঠতি বাজার’ বিবেচনায় ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের জায়গা তৈরি হবে।
১০. সম্প্রতি বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলারের বেশি উন্নয়ন সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) চুক্তি সই হয়েছে। যাতে স্বাস্থ্য, সুশাসন, মানবিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি ও মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এই অর্থ কাজে লাগানো হবে আশা করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে ৯৮০ কোটি ১৭ লাখ ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ১৬৯ কোটি ৮ লাখ ডলার, যা মোট রপ্তানির ১৭ শতাংশেরও বেশি। একক গন্তব্য দেশ হিসেবে এ সময় যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। দেশটিতে প্রধানত তৈরি পোশাক, মৎস্য, হোম টেক্সটাইল, কাঁচা পাট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ও হস্তশিল্পজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
অভিবাসন ও রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের অন্য কোনো ক্ষেত্রে নেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বাণিজ্য খাতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তা মূলত যুক্তরাষ্ট্রে বৃহদায়তনে রপ্তানির ওপরই প্রভাব পড়বে।
দেশটির মোট আমদানিতে বাংলাদেশের অবদান খুবই যৎসামান্য। সে হিসেবে তার বাণিজ্যসংক্রান্ত পদক্ষেপগুলোয় বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে মার্কিন প্রশাসন দেশটি থেকে অন্য দেশে অর্থ পাঠানোর ওপর কর আরোপ করলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে এর প্রভাব পড়তে পারে। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্যারিফ আরোপ করে এর প্রভাব পড়বে ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড় দেশগুলোয়। তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আমরা নই।
ইসরাইল ফিলিস্তিন ইস্যু কিংবা ইউক্রেন ইস্যুর মতো জটিল সমীকরণ আছে ট্রাম্পের সামনে। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সরাসরি ভাবনার সময় কোথায়? বরং তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে প্রতীয়মান করতে চাইবেন বারংবার। তিনি চাইবেন না নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে।
লেখক: শিক্ষক, সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
মন্তব্য