নানা সেক্টরের দাবি-দাওয়া, রাজনৈতিক যন্ত্রণা, সংস্কার, দ্রুততম সময়ে নির্বাচন ইত্যাদি আলোচনার মাঝে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ে যেন ভাবার সময় নেই। যে ডেঙ্গুতে ভুগছে, সে-ই টের পাচ্ছে, তার কাছেই এটি খবর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে কতজন মরেছে, আক্রান্তের সংখ্যা জানানো রুটিন দায়িত্ব।
আসল যাতনা-বেদনা কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির আর তার স্বজনদের। গত ক’দিন দেশে জোড়া, হালি এমনকি ডজনে ডজনেও মানুষ মরছে এই ভাইরাসজনিত রোগে। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই দেওয়ার অবস্থা নেই। কিন্তু, এ যেন তেমন ঘটনা নয়। নিয়তি বা আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে, ভাবনার মধ্যে বিষয় শেষ। লক্ষণীয় ব্যাপার গণমাধ্যমেও এসব মৃত্যু বড় দাগের খবর নয়। এর চেয়ে বড় বড় বা গরম কত খবর পড়ে আছে!
রাজনৈতিক ব্যস্ততা ও নানা দফারফার তোড়ে মাঠি এখন ডেঙ্গুর করদরাজ্য। জন্মাতে, বেড়ে উঠতে, মানুষকে কামড়িয়ে রোগী বানাতে তেমন বাধা নেই। সময়ই বা কই? টানা আন্দোলন, সরকার পতন, নতুন সরকার গঠন। ড. ইউনূস সরকার দায়িত্ব নিতে না নিতেই কয়েক এলাকায় বন্যা। নিত্যপণ্যের বাজারে আগুনের তীব্রতা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ। এর ছয় সপ্তাহের মাথায় সরিয়ে দেওয়া হয় কাউন্সিলরদেরও।
আগস্টের শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে ও দপ্তরে অনুপস্থিত থাকায় ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়র, ৩৩০ জন পৌর মেয়র ও প্রশাসক এবং প্রায় সব জেলা-উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৮০ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৭৫ শতাংশ কাউন্সিলর এখনো অনুপস্থিত। মশক নিধন অভিযানে স্থবিরতা। পুরো সময়টা মশাদের অনুকূলে।
প্রশাসক নিয়োগ হয়েছে। নাগরিক সেবা সচল রাখতে ১৭ সদস্যের কমিটি মাঠে থাকলেও ডেঙ্গুবাহী মশাদের জন্য তা সুযোগ। ফাঁকা মাঠে অ্যাকশন তাদের। দিনে দিনে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে তা রোখা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠেছে। এবার এমনিতেই পিকটাইমে মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়নি প্রথমে আন্দোলনের কারণে, পরে সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরদের বাদ দেওয়ার কারণে। এছাড়া, দেশের স্বাস্থ্যনীতি ক্রমেই অভিমুখ পাল্টেছে। মশা দমনে সরকার কিংবা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা মোটেও আশাপ্রদ নয়।
মানবদেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না। জনস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, ডেঙ্গুর অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। মশক নিধনে ক্রমাগত ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতাও ডেঙ্গু বিস্তারে ভূমিকা পালন করছে। এলাকা বা মহল্লাভিত্তিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করা, বাসার ছাদ, বাড়ির আশপাশ, দুই বাড়ির সীমানায় নোংরা জায়গাগুলো পরিষ্কার করার কাজ থমকে গেছে।
দিনে দিনে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে তা রোখা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠেছে। এবার এমনিতেই পিকটাইমে মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়নি প্রথমে আন্দোলনের কারণে, পরে সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরদের বাদ দেওয়ার কারণে। এছাড়া, দেশের স্বাস্থ্যনীতি ক্রমেই অভিমুখ পাল্টেছে। মশা দমনে সরকার কিংবা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা মোটেও আশাপ্রদ নয়।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। ডেঙ্গু মশা সাধারণত পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে, যা খুব সহজেই শহরের বিভিন্ন জায়গায় জমা হওয়া বৃষ্টির পানি বা বাড়ির আশপাশের অযত্নে পড়ে থাকা পাত্রে জমে থাকা পানিতে হতে পারে।
এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায় এ ধারণা পালটে গেছে। দেখা যাচ্ছে, এডিস মশা এখন দিন-রাত যেকোনো সময় সমানে মানুষকে কামড়ায়। শহরাঞ্চলের অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও যথেষ্ট নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব ডেঙ্গুর বিস্তারকে আরও জটিল করে তুলছে। বছর কয়েক ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার পাশাপাশি বাংলাদেশেও ডেঙ্গু একটি মারাত্মক রোগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে এই রোগের প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। মৃত্যুও অনেক। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে থাকে। আক্রান্ত দেশগুলোতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি নজরদারি। সেখানে এখন বিশাল শূন্যতা। এর জেরে এবার মধ্য আগস্ট থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী অবিরাম বাড়ছে।
রোগ হিসেবে ডেঙ্গু বেশ প্রাচীন। এ রোগের প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে চীনের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্রে। সেখান থেকে জানা যায়, চীনে এই রোগটি ৯৯২ খ্রিস্টাব্দে শনাক্ত করা হয়। কোনো কোনো গবেষক অবশ্য দাবি করেন, চীনে জিন রাজতন্ত্রের সময়কার (২৬৫-৪২০ খ্রিস্টপূর্ব) নথিপত্রে এই রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে অবশ্য একে উড়ন্ত পোকামাকড়ের কারণে ‘বিষাক্ত পানির’ রোগ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই জ্বরকে শনাক্ত এবং ডেঙ্গু জ্বর বলে নামকরণ করা হয় ১৭৭৯ সালে। এরপরের বছর প্রায় একই সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। শরীরে ব্যথার কারণে তখন একে ‘হাড়ভাঙা জ্বর’ বলেও ডাকা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খুব দ্রুত নগর-বন্দরগুলো তৈরি হতে শুরু করে, যা এই রোগের বিস্তার বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মহামারি আকারে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালের দিকে ফিলিপিন্স এবং থাইল্যান্ডে। ১৯৭০ সালের আগে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে একশোটির বেশি দেশে ডেঙ্গু জ্বর হতে দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হয় ২০০০ সালে, শনাক্ত হলেও প্রথমে অবশ্য এই জ্বরটি ঢাকায় একসঙ্গে অনেকে হয়েছিল বলে এর নাম হয়ে যায় ‘ঢাকা ফিভার’। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটি ডেঙ্গু জ্বর বলে শনাক্ত করেন।
তথ্য, যুক্তি-তর্ক-বৈজ্ঞানিক যে ব্যাখ্যাই থাক, কঠিন এক বাস্তবতায় ডেঙ্গুর বিষয়ে ভাবনার ফুসরত কারো নেই। নিজে বা কোনো স্বজন আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত ডেঙ্গু কোনো বিষয় নয়। এটি আউট অব সিলেবাস। ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছেন, করোনার চেয়ে ডেঙ্গু কম ভয়ংকর নয়। তারওপর করোনা এখনও ভয়, ডেঙ্গু মূর্তিমান আতঙ্ক। করোনা গুড বাই দিয়েছে, এমন ঘোষণা বা তথ্য নেই। মাঝে-মধ্যে করোনায় দু’একজনের মৃত্যু সংবাদও দেখতে হয়, শুনতে হয়।
লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য