-->
শিরোনাম

শীতেও ডেঙ্গু, বাঁচবেন কীভাবে?

ড. কবিরুল বাশার
শীতেও ডেঙ্গু, বাঁচবেন কীভাবে?

মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করছি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে। এযাবৎকালে মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে যে পূর্বাভাস দিয়েছি তার প্রতিটি সঠিক হয়েছে। এই নভেম্বরের শীতেও দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিন হাজারের ওপরে মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ডিসেম্বরে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও অন্যান্য বছরের মতো হবে না। ডেঙ্গুর ২০২৪ সালের ধাক্কা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে গিয়ে লাগবে।

সরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিল এবং মারা গিয়েছিল ১৭০৫ জন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ভর্তি হয়েছে ৩০ হাজার ৮৭৯ জন। এই রোগী ছাড়াও প্রচুর রোগী ছোট বড় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এবং বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছে এবং নিচ্ছে।

আবার কিছু রোগী আছে যারা জ্বর আসলে পরীক্ষা না করিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছে অথবা কবিরাজের কাছে যাচ্ছে। এই রোগীদের মধ্যেই প্রকৃত চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।

পৃথিবীতে উষ্ণ অঞ্চলের অনেক দেশেই ডেঙ্গু রোগী আছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি আছে ব্রাজিলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সালে মৃত্যুহার ছিল ০.৫৩ যা ২০২৪ সালে কিছুটা কমে আসলেও সেটিও অনেক বেশি মাত্রায় রয়েছে।

২০২৪ সালে শীতেও ডেঙ্গু কেন বেশি থাকবে এবং তার বিজ্ঞানভিত্তিক কারণইবা কী? এর থেকে বাঁচার উপায় কী? কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? এরকম নানান প্রশ্ন সাধারণ নাগরিক এবং মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ডেঙ্গু রোগের ঝুঁকি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গুরবাহক এডিস মশা তার প্রজনন এবং বসবাসের জন্য নতুন নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণও বাড়ছে।যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের সরাসরি সম্পর্ক নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এখনো পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা যে করোনাভাইরাসের মতো ডেঙ্গু ভাইরাসও পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।

পৃথিবীতে উষ্ণ অঞ্চলের অনেক দেশেই ডেঙ্গু রোগী আছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি আছে ব্রাজিলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে।

ডেঙ্গুর প্রকোপ কম বা বেশি হওয়ার পেছনে জনসাধারণের সচেতনতা, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে তাদের সহযোগিতা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের গবেষণা দল ডেঙ্গুরবাহক এডিস মশার ঘনত্বের যে গবেষণা করছে, তা থেকেও স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে যে, পরিস্থিতি খুবই জটিল।

ব্রুটো ইনডেক্স নামে পরিচিত মশার ঘনত্বের সূচক যদি কোনো এলাকায় ২০-এর ওপরে থাকে, তবে সেই এলাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রভৃতি রোগের ঝুঁকি বেশি হয়। আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে ব্রুটো ইনডেক্স এখনো ২০-এর ওপরে রয়ে গেছে। এডিস মশার ঘনত্ব এমনই থাকলে নভেম্বর-ডিসেম্বরে শীতের মাঝেও ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে না। যদি আর বৃষ্টি না হয় তাহলে হয়তো এডিস মশাগুলো কিছু কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধ হবে যেখানে বৃষ্টি ছাড়াই পানি জমা হয়।

আমাদের দেশে সাধারণত শীতকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ কমে আসে, কারণ ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মশার প্রজনন কম হয়। তবে চলমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২৪ সালে পরিস্থিতি ব্যতিক্রমও হতে পারে। তাই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও তৎপর হতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও ২০২৪ সালের শীতে বেশিসংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। জরুরিভিত্তিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে নভেম্বর-ডিসেম্বর পেরিয়ে এই ধাক্কাটি চলে যাবে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। অন্যান্য বছরের মতো এবছর শীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা খুব বেশি কমবে না।

মাঠ পর্যায়ে আমাদের গবেষণা দলের কাজের ফলাফল থেকে যেটি দেখছি নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে জমা পানি, যেসব এলাকায় পানির সংকট আছে তাদের টয়লেট এবং গোসলখানায় গ্রামে বালতিতে জমিয়ে রাখা পানি, বাড়ির ওয়াসার মিটার সংরক্ষণের জন্য নির্মিত চৌবাচ্চায় জমা পানি এবং বহুতল ভবনের বেজমেন্টে গাড়ির পার্কিংয়ে গাড়ি ধোয়ার জায়গাতে জমা পানি শীতকালে এডিস মশা প্রজননের জন্য অতি উত্তম ক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত হবে।

শীতের সময়ে বৃষ্টি না থাকার কারণে রাস্তাঘাট উন্মুক্ত স্থানে যে ছোট বড় পাত্র পড়ে থাকে সেখানে পানি না জমা হওয়ার কারণে মা মশা খুঁজে খুঁজে ওইসব স্থানে ডিম পারবে যেখানে পানি জমা হওয়ার জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে তারা ড্রেন বা বদ্ধ যেকোনো পানিকে ডিম পাড়া বা তার প্রজননের জন্য ব্যবহার করতে পারে। তাই শীতকালে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামকে উপরোক্ত প্রজনন স্থলগুলো বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে।

শীতকালে ডেঙ্গু কিছু কিছু বাড়িতে বা এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। এই এলাকাগুলো বিজ্ঞানের ভাষায় ডেঙ্গুর হট স্পট বলা হয়। এই হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে সেইখানে দ্রুত ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করা অপরিহার্য। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসাধারণকেও এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে হবে।

ডেঙ্গু রোগীর বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে সেই বাড়ির চারপাশে নিয়মিত ফগিং করে এডিস মশা নিধন করতে হবে, যাতে ভাইরাসবাহিত মশাটি অন্য কাউকে সংক্রমিত করতে না পারে। হটস্পট ছাড়া অন্য কোনো স্থানে ফগিং করার প্রয়োজন নেই। যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হয় সেসব হাসপাতাল ও তার আশপাশে নিয়মিত ফগিং করতে হবে এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সর্বদা মশারির নিচে রাখতে হবে, যাতে এডিস মশা রোগীর কাছাকাছি আসতে না পারে।

মেয়র আসে মেয়র যায় ঢাকার মশাও থেকে যায় ডেঙ্গুও থেকে যায়। বর্তমান সময়ে যারা মশা বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের ওপর আস্থা রাখতে চাই।

আগামী ১৫ দিন হটস্পট এলাকাগুলোয় মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের জন্য ব্যাপক কার্যক্রম চালালে হয়তো ডিসেম্বরে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে হবে। নগরবাসী তাদের ঘরবাড়ি ও আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে সচেতন থাকলে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

যদি কারও বাসা বাড়ি বা অন্য কোথাও পানি জমিয়ে রাখার প্রয়োজন পড়ে তাহলে পানির পাত্রটি তিনদিন পরপর ভালো করে সাবান বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ঘষে ধুয়ে পরিষ্কার করে তারপর আবার পানি রাখতে হবে। ঢাকার মতো ডেঙ্গুর অবস্থা যাতে অন্য শহরগুলোয় না হয়, সেজন্য প্রতিটি নগরের প্রশাসনকে সজাগ থাকতে হবে। সঠিক সময়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গ্রহণ করলে ডেঙ্গু সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব।

মেয়র আসে মেয়র যায় ঢাকার মশাও থেকে যায় ডেঙ্গুও থেকে যায়। বর্তমান সময়ে যারা মশা বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের ওপর আস্থা রাখতে চাই। আমার বিশ্বাস সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা মশা এবং ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে সামর্থ্য হবেন।

আগামী মাসগুলোয় কিউলেক্স মশার প্রকোপ বাড়বে, তাই এখন থেকেই কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হলে শুরুতেই এটিকে শাসনে আনা সম্ভব। নগর প্রশাসকগন নিশ্চয়ই এ বিষয়েও মনোযোগ দেবেন।

লেখক: অধ্যাপক, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version