-->

বন্ধ চিনিকল খুলে আখ চাষিদের পাশে দাঁড়াতে হবে

ইয়াহিয়া নয়ন
বন্ধ চিনিকল খুলে আখ চাষিদের পাশে দাঁড়াতে হবে

দেশে চিনি উৎপাদনের কারখানা পনেরটি। এর মধ্যে নানা কারসাজি করে ছয়টি কারখানা চার বছর ধরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পনেরটি চিনিকলের চারপাশজুড়ে ব্যাপক কৃষি জমিতে আখ চাষ করে আসছেন কৃষক। ছয় কারখানা বন্ধের ফলে চার বছর ধরে নানা সংকটে রয়েছেন ওই অঞ্চলের আখ চাষিরা। যারা গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে জড়িত।

ভয়াবহ সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ছয় কারখানা বন্ধ করে বিপদে ফেলে দেয়া হয়েছে তাদের। দেশের কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে চিনি। যা উচ্চমূলে ক্রয় করছে মানুষ। গত মাড়াই মৌসুমে ৯টি চিনিকলে চিনি উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ২১ হাজার ৩১৪ টন, যেখানে দেশের চাহিদা ১৮ লাখ টন। এ সুযোগে চিনি পরিশোধন কারখানাগুলো সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে নানা অজুহাত ও কৌশলে ৬০-৬৫ টাকা মূল্যের চিনি ১৩০ থেকে১৬০ টাকা কেজিতে কিনতে বাধ্য করেছে আমাদের।

রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের হাত থেকে দেশের আখ মাড়াই কারখানাগুলো বাঁচাতে হবে। সেই সাথে বাঁচবে কৃষক। কারণ, একবার কোনো এলাকা থেকে আখ চাষ উঠে গেলে, সেখানে নতুন করে আখ চাষ করা অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কোনো এলাকায় দু-একজন কৃষক আখ চাষ করলে তা গরু-ছাগল ও মানুষ খেয়ে ফেলে। এছাড়া অন্য ফসলের তুলনায় আখ চাষে প্রচুর বীজের প্রয়োজন হয়।

এক একর জমিতে ধান চাষে বীজ (ইনব্রিড) লাগে ১০ থেকে ১২ কেজি। পাট চাষে বীজ লাগে (ছিটিয়ে বুনলে) মাত্র তিন কেজি। আলু রোপণে বীজ লাগে ৬০০ কেজি মাত্র। অন্যদিকে এক একর জমিতে আখ চাষ করতে বীজ লাগে ২৪০০-২৫০০ কেজি। এ বিপুল পরিমাণ বীজ পরিবহন, বীজ তৈরি, বীজ শোধন ও রোপণ করাটা খুব সহজ কাজ নয়।

আখ চাষিদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বীজ ছাড়া অন্য মিল থেকে বীজ এনে আখ চাষে সফলতা অর্জন খুব কঠিন কাজ। এজন্য লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক আখ চাষের পূর্ব শর্ত হলো, বাণিজ্যিক আখ চাষের কমপক্ষে এক বছর আগে স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গুণগত মানের উচ্চফলনশীল জাতের বীজ উৎপাদন। তাই বন্ধ চিনিকলগুলো চালু করার ক্ষেত্রে এসব বিষয় খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।

পৃথিবীর অন্যান্য আখ উৎপাদনকারী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে হেক্টরপ্রতি আখের ফলন অনেক কম, যা চিনি শিল্প বিকাশের অন্যতম প্রতিবন্ধক। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী আখের গড় ফলন ছিল ৭৪ টন আর পেরুতে ছিল হেক্টরপ্রতি ১২১ টন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে আখের হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৭০-১০০ টন। অন্যদিকে বাংলাদেশে আখের গড় ফলন মাত্র ৪৫ থেকে ৭৪ টন।

আখ বীজকে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৯৫ শতাংশ আর্দ্রতার গরম বাতাসে ৪ ঘণ্টা শোধন করে আখের মারাত্মক ছয়টি রোগ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য আখ উৎপাদনকারী দেশে বহুদিন আগে থেকেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আখের ফলন বৃদ্ধি, গুণগত মানের আখ উৎপাদন এবং চিনি আহরণ হার বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে একটি মিলেও আজ পর্যন্ত গরম বাতাসে বীজ শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই।

নতুন করে পুরাতন কারখানাগুলো চালু করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সব বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নামতে হবে। তাহলে আর কারখানা বন্ধ করতে হবে না। চিনির বাণিজ্য সিন্ডিকেট এমনিতেই অকার্যকর হয়ে যাবে। এভাবেই আখ মাড়াই কারখানাগুলো চালু করে কৃষক বাঁচাতে হবে। সেই সাথে চিনি নিয়ে চালবাজির কারবার বন্ধ হয়ে যাবে।

আর্দ্র গরম বাতাসে বীজ শোধনের আরো কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন এতে গরম পানিতে শোধিত বীজের চেয়ে অঙ্কুরোদগম হার অনেক বেশি এবং একরপ্রতি বীজও লাগে কম। তাই আমাদের দেশেও আর্দ্র গরম বাতাসে বীজ শোধনযন্ত্র স্থাপন করে রোগমুক্ত ভিত্তি বীজ উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। এসব নিয়ে সংশ্লিষ্ট কারো যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়াবার।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ ছয়টি চিনিকল আবার পর্যায়ক্রমে চালু করতে চাচ্ছে। এই খবরে ওই এলাকাগুলোতে আখচাষিদের মধ্যে ব্যপক সাড়া পড়ে গেছে। সচেতন নাগরিকদের কথা হচ্ছে, মিলগুলো এমনভাবে চালু করতে হবে যাতে নতুন চালুকৃত মিলগুলোকে লোকসানের বদনাম বহন করতে না হয়। এজন্য আখ থেকে শুধু চিনি নয়, আখের উপজাত থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে কৃষিভিত্তিক এ শিল্পকে লাভজনক করে তুলতে হবে। এজন্য চীন, ব্রাজিলের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন ও মেরামত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

চিনিকলের কাঁচামাল তথা গুণগত মানের উচ্চফলনশীল ও উচ্চ চিনি আহরণযুক্ত আখের অভাব হলো এ শিল্পের আরেকটি সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সুগার ক্রপ গবেষণাপ্রতিষ্ঠানকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। প্রায়ই দেখা যায়, আখের অভাবে মিলগুলো নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে যায় এবং চিনি ও মোলাসেস উৎপাদন ব্যাহত হয়। চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। তাই লাভজনক চিনি শিল্পের জন্য গুণগত মানের পর্যাপ্ত আখ সরবরাহে কোনো বিকল্প নেই।

আখ চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়াতে হলে আখ সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আখের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। আখ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন বীজ, সার, বালাইনাশক, নালা কাটা ও সেচের জন্য নগদ অর্থ সময়মতো আখচাষীদের মধ্যে আমদানিনির্ভর কৃষিপণ্যের মতো স্বল্প সুদে (৪ শতাংশ) ঋণ হিসেবে বিতরণ করতে হবে।

পাশাপাশি ইক্ষু জরিপ, ফলন জরিপ এবং পুর্জি প্রদানে কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি বা অনিয়ম বরদাশত করা যাবে না। কেউ এ অপকর্মে জড়িত হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আখখেতে সময়মতো সার প্রয়োগ আগাছা দমন, সেচ প্রদান ও আখের অনিষ্টকারী পোকা ও রোগ দমনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য আখ উন্নয়ন সহকারী ও আখচাষীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।আখের আবাদ, আখের ফলন বৃদ্ধির ব্যাপারে সম্প্রসারণ কর্মকাণ্ড আরো জোরদার ও গতিশীল করার কোনো বিকল্প নেই। আখ উৎপাদনকারী দেশের মতো কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা রাজস্ব খাত থেকে প্রদান করা জরুরি। চালুকৃত মিলগুলোয় কেরু অ্যান্ড কোম্পানির মতো ডিস্টিলারি স্থাপন করে অ্যালকোহল, জৈব জ্বালানি, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, ভিনেগার ও প্রেসমাড থেকে জৈব সার উৎপাদনের ব্যবস্থা করে পণ্য বহুমুখী করতে হবে।

নতুন করে পুরাতন কারখানাগুলো চালু করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সব বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নামতে হবে। তাহলে আর কারখানা বন্ধ করতে হবে না। চিনির বাণিজ্য সিন্ডিকেট এমনিতেই অকার্যকর হয়ে যাবে। এভাবেই আখ মাড়াই কারখানাগুলো চালু করে কৃষক বাঁচাতে হবে। সেই সাথে চিনি নিয়ে চালবাজির কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমান সরকার সঠিক ভাবে কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে বলে ভরসা আখচাষি এবং কারখানাগুলোর শ্রমিক কর্মচারিদের।

লেখক: সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version