-->

দেশমাতৃকার সেবায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা

লে. কর্নেল মেছবাহুল আলম সেলিম
দেশমাতৃকার সেবায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা

২১ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর সমন্বিত আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং স্থল, নৌ ও আকাশপথে প্রথমবারের মতো সার্বিক অভিযান পরিচালনা করা হয়, যা চূড়ান্ত বিজয় ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের অভিযান পরিচালনার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। সশস্ত্রবাহিনী দিবসটি মূলত স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক সেই বীরত্বগাঁথা ও ত্যাগের ইতিহাসকে স্মরণের লক্ষ্যে পালিত হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত্রিতে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের নিরীহ জনসাধারণের ওপর বর্বর আক্রমণ শুরু করে, তখন থেকেই বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ যার যার অবস্থান থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যগণ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ-যুদ্ধে লিপ্ত হন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং নিজেদের জীবন বিপন্ন করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালায়। এর ফলে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যগণ পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর সদস্যগণ স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পরই বাংলাদেশে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর ইউনিটসমূহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই শুরু করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসরগ্রহণকারী কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) আতাউল গণি ওসমানী বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োজিত হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সেনাসদস্যগণ মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এবং সেই সকল প্রশিক্ষিত সদস্যদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। পরবর্তীতে সুসংহত সামরিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং শক্ত প্রতিরোধ সূচনার লক্ষ্যে সমগ্র দেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়, যেখানে অধিকাংশ সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাবৃন্দ। সামরিক শক্তির দিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য সেনাসদস্যগণ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলে গেরিলা অভিযান পরিচালনা শুরু করেন। এর মাধ্যমে তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস, রসদ সরবরাহ বিঘ্ন ঘটানো এবং যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ধ্বংসের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক সক্ষমতা হ্রাস করা এবং দখলদার বাহিনীর মনোবল দুর্বল করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণে অংশগ্রহণ করে এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই যুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়েই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যগণ প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছেন, যা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মকে ত্বরান্বিত করেছে। সেনাসদস্যদের এই সাহসিকতা ও ত্যাগের ফলে আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময় নৌবাহিনী মূলত দুইটি ধাপে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রথম ধাপে তারা দখলদার পাকিস্তানি নৌবাহিনীর ওপর হামলা পরিচালনা করে এবং দ্বিতীয় ধাপে মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা বাহিনীকে সহায়তা প্রদান করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীর বাঙালি অনেক কর্মকর্তা ও নাবিক পাকিস্তান নৌবাহিনীর দমননীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানিদের অত্যাচার এবং জাতিগত বৈষম্যের কারণে তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেক নৌবাহিনীর সদস্যগণ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান এবং সেখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনীর ন্যায় নৌবাহিনীর সদস্যগণও গেরিলা কৌশলে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। বিশেষ করে নদীবহুল বাংলাদেশে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধ ও রসদ জাহাজের ওপর আক্রমণ করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর একটি ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে এই অভিযানে নৌ-কমান্ডোগণ চট্টগ্রাম, মোংলা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের বিভিন্ন বন্দরে একযোগে আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করে। নৌবাহিনীর সদস্যগণ ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন সমুদ্র ও নদী উপকূলে অভিযান পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে আগত নৌযান বাংলাদেশ উপকূলে ভিড়তে বাধা প্রদান করে এবং বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে প্রাধান্য বিস্তার করে। এছাড়াও নৌবাহিনীর সদস্যগণ নৌপথে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ, অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই সঙ্গে তারা নদীপথে মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানান্তরের মাধ্যমে দ্রুত আক্রমণ পরিচালনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নৌবাহিনীর সদস্যগণ অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের গেরিলা যুদ্ধকৌশল ও কার্যকর অপারেশনসমূহ পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ে অসামান্য অবদান রেখেছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনীর অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যুদ্ধকালীন সময় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কোন অস্তিত্ব ছিল না, কারণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) সামরিক স্থাপনাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমান বাহিনীর অধিকাংশ বাঙালি সদস্যগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগদান করেন এবং মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বিমান স্থাপনাসমূহের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এমতাবস্থায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মুক্তিকামী বাঙালি সদস্যগণ পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। এরমধ্যে ১৯৭১ সালের ২০ই আগস্ট পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান বিমানসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শহীদ হন। এছাড়াও বিমান বাহিনীর অনেক সদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণগ্রহণ করেন। ভারতের সহায়তায় সংগৃহীত কিছু সিভিল বিমান ও হেলিকপ্টার বিমান বাহিনীর সদস্যগণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে সামরিক আকাশযানে রূপান্তর করেন। উক্ত বিমান ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো সক্রিয় অভিযান পরিচালনা করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলমের নেতৃত্বে ‘কাগমারি অপারেশন’ নামে পরিচিত এই অভিযানে পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালানো হয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ভারতীয় বিমান বাহিনীর সহায়তায় তারা বাংলাদেশের আকাশে পাক-বাহিনীর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় এবং আকাশপথে পাক-বাহিনীর বিমান আক্রমণের গতি কমে আাসে। বিমান বাহিনীর সদস্যগণ গেরিলা আক্রমণেও যুক্ত ছিলেন এবং তারা পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা ও রসদ সরবরাহ কার্যক্রম বিঘ্নিত করেন। বিমান বাহিনীর সদস্যগণের এই দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জয়ের পথ সুগম হয়।

ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে জন্মগ্রহণ করা বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশমাতৃকার সেবায় সদা নিয়োজিত। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’- এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবহিনী দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং বর্হিশত্রুর হুমকি মোকাবিলা ছাড়াও সন্ত্রাস দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, জঙ্গি দমন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা রোধকল্পে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমি-পাহাড় ধস, ভবন ধস, মহামারি ইত্যাদি ঘটনার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক উদ্ধার কার্য পরিচালনা, ত্রাণ কার্যক্রম, চিকিৎসাসেবা এবং পুনর্বাসনের মতো মানবিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে সেতু, রাস্তা, ফ্লাইওভার, রেলপথসহ বিভিন্ন প্রকল্প স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে। এছাড়াও জাতীয় পরিচয়পত্র তথা ভোটার আইডি কার্ড প্রস্তুত, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ও ভিসা (এমআরপি ও এমআরভি) প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুদায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সুষ্ঠুভাবে পালন করেছে। শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনী উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র, বিশেষ শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে।

‘শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়’- দেশের জলসীমার অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ নৌবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা ও প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে স্থিত বিস্তৃত নৌ-সীমান্তের নিরাপত্তা বিধান করা নৌবাহিনীর অন্যতম প্রধান দ্বায়িত্ব। নৌবাহিনী নদী, সমুদ্্রপথ ও উপকূলীয় অঞ্চলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধ, চোরাচালান, অবৈধ মাদক পাচার, মৎস্য আহরণ, উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ধরনের দ্বায়িত্ব পালন করে থাকে। এছাড়াও নৌবাহিনীর সদস্যগণ বাংলাদেশের জলসীমায় যেকোনো ধরনের নৌ-দুর্ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা এবং দুর্যোগকালীন সময়ে উদ্ধার কার্যক্রম, ত্রাণ বিতরণ এবং দুস্থদের পুনর্বাসনে সর্বদা নিয়োজিত থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

‘বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত’- এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনী সশস্ত্র বাহিনীর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুক্তিযুদ্ধ শেষে নবগঠিত বিমানবাহিনী বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করে। শুধুমাত্র সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশ হিসেবেই নয়, বরং তারা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিমান বাহিনীর সদস্যগণ দুর্যোগকালীন ও জরুরি পরিস্থিতিতে উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা, চিকিৎসাসেবা প্রদান, মেডিকেল ও ক্যাজুয়ালিটি ইভাকুয়েশন, অগ্নিনির্বাপণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সদা সর্বদা নিয়োজিত থাকেন। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিমান স্থাপনার নিরাপত্তায়ও নিয়োজিত থাকেন। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রেও বিমান বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে অনেক দেশে আজ বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা সগৌরবে উড়ছে। বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেছে। সর্বোচ্চ সংখ্যক শান্তিরক্ষী প্রেরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিশ্বের বুকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ ভূমিকা রয়েছে। নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, কর্মদক্ষতা, মানবিক মনোভাব ও পেশাদ্বারিত্বের মাধ্যমে বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এছাড়াও বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম অনেক দেশ যেমন- জাপান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, হাইতি, তুরস্ক ইত্যাদিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ নিয়োজিত হয়ে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।

জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন লোকসানি প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন- বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট লিমিটেড, খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড, ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড ইত্যাদি সশস্ত্র বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পর সেগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।

সশস্ত্রবাহিনী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে এক পরম আস্থার নাম। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এবং এই মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে জন্ম হয় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বিত আক্রমণ সূচনার মাধ্যমে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। জনগণের এই সশস্ত্রবাহিনী বাংলার জনগণকে সঙ্গে নিয়েই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে অর্জন করে বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। ঐতিহাসিক এই বিজয় অর্জনের সম্মিলিত প্রয়াসকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য প্রতি বছর এই দিনটিকে বাংলদেশে সশস্ত্রবাহিনী দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আলোকিত বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী দেশের প্রয়োজনে বহুবার নিয়োজিত হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একটি পেশাদার ও আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ এক অনন্য গতিতে সামনে এগিয়ে চলছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সশস্ত্র বাহিনীকেও যুগোপযোগী ও আধুনিক হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। দেশপ্রেমের আদর্শে বলীয়ান হয়ে ২১ নভেম্বরের চেতনায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশের অগ্রযাত্রায় শরিক হতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্য বদ্ধপরিকর।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version