-->

আলুর মাহাত্ম্য

চিররঞ্জন সরকার
আলুর মাহাত্ম্য

ডিমের পর গোল বাঁধিয়েছে আলু। দাম বাড়ছে হু হু করে। কিছুতেই দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ট্রাকে ট্রাকে আমদানি করেও না। আলুর কেজি ৬০-৭০ টাকা হওয়ায় অনেকেরই মাথায় হাত। কারণ আজকের দিনে আলু ছাড়া জীবন অসহায়। বাঙালির এখন আলু ছাড়া চলে না। যেকোনো খাবারে আলুর মিশ্রণ থাকবেই। আলুকে বলা হয় সবজির রাজা। ওই আলুর যখন দাম বাড়ে কখন মানুষ চোখে শর্ষের ফুল দেখে।

অথচ এই আলু চারশ বছর আগেও বাংলাদেশ বা এর আশপাশে কেউ চোখে দেখেনি। এর নামও জানত না অনেকে। আলুর ইতিহাস বেশ পুরনো এবং মজার। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে প্রায় সাত হাজার বছর ধরে এর চাষ হয়ে আসছে। আলু ইউরোপীয়দের নজরে আসে পঞ্চদশ শতকে, যখন ১৫৩২ সালে স্পেনের নাবিকেরা দক্ষিণ আমেরিকায় আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। স্প্যানিশরা পেরুতে স্বর্ণের খোঁজে গিয়েছিল কিন্তু পেয়েছিল আলুর আবাদ। ফেরার পথে তারা সঙ্গে করে আলু নিয়ে আসে, যা নাবিকদের স্কার্ভি রোগ থেকে বাঁচায়। কারণ আলুতে ভিটামিন সি আছে। কিছু আলু স্পেন পর্যন্ত নিয়ে আসা হয় এবং ১৫৬৫ সালের দিকে এটি প্রথমবারের মতো পেরু থেকে ইউরোপে পৌঁছায়। ষোড়শ শতকে স্প্যানিশদের হাত ধরেই আলুর আবাদ ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে।

সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজ নাবিকরা ভারতবর্ষে প্রথম আলু নিয়ে আসে বলে ধারণা করা হয়। পর্তুগিজরা দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় আলু বোঝাই করে নিয়ে আসত। কারণ আলু সহজে পচে না। সেদ্ধ করেই খাওয়া যায়। পেট ভরা থাকে অনেকক্ষণ। কিন্তু আলুকে ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়াতে কাজ করেছিল ইংরেজরা। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষের প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত টানা ১৩ বছর দায়িত্বে থাকাকালে নিজ উদ্যোগে আলুর চাষ করেছিলেন। এতে তার অবশ্য বাণিজ্যিক অভিসন্ধি ছিল। তিনি মূলত চেয়েছিলেন ভারতে কম দামে আলু চাষ করে ইউরোপে বিক্রি করতে। যেভাবে নীল চাষের পত্তন হয়েছিল।

নৃতাত্ত্বিকদের মতে, পেরুর প্রাচীন ইনকা সভ্যতায় মানুষজন চাষের জমিকে ‘আলু’ বলত। পরবর্তীকালে সেটা থেকেই ‘আলু’ নামটি এসেছে বলে অনেকের অনুমান। আমাদের অঞ্চলেও চাষের জমিতে ‘আল’ থাকে। এই চাষের জমির নাম ‘আলু’ থেকে আল’ কথাটি এসেছে বলে কারও কারও অভিমত। মোগল যুগের ঐতিহাসিক আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবরী’-তে ‘আল’ দিয়ে ঘেরা বলে বাংলাদেশকে ‘বঙ্গাল’ (বঙ্গ+আল=বঙ্গাল) বলা হয়েছে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে আলুর উল্লেখ দেখা যায়। যেমন, পালযুগের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর লেখা ‘রামচরিত’ কাব্যে যে ‘বারাহী কন্দের’ উল্লেখ রয়েছে, সেটিকে একটি উচ্চ প্রজাতির আলু বলছেন রতিকান্ত শাস্ত্রী তার ‘প্রাচীন বাংলার শিলা ও তাম্রলিপিতে সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে।

যাই হোক, বাংলাদেশে এখন আলু এতটাই জনপ্রিয় যেকোনো না কোনো পদে আলু থাকতেই হয়। আলু বাংলার মানুষের কাছে এত দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ এর সহজলভ্যতা। এটা অল্প জমিতে অনেক বেশি ফলে। এতে কৃষকরা লাভবান হন। আবার দামে কম হওয়ায় ভোক্তারাও কিনতে পারেন। এছাড়া আলু খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণও ভাতের চাইতে বেশি। তাই আলু সারাদেশের মানুষ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে গেল নব্বই দশকে আলু খাওয়া নিয়ে একটি পোস্টার ছাপানো হয়েছিল। তাতে সেøাগান ছিল ‘বেশি করে আলু খাও, ভাতের ওপর চাপ কমাও।’ আলুর ফলন বাড়াতে আশির দশক থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দেশের আলুর জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করা শুরু করেন।

বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে বারি ১ থেকে ৯১-সহ আরও বিভিন্ন জাতের আবাদ হয় যার বেশিরভাগের উৎপত্তিস্থল নেদারল্যান্ডস। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত জাত হলো ডায়মন্ড (ডিম্বাকার), কার্ডিনাল (লালচে আলু), গ্রেনুলা (গোল আলু)। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

আলুর সঙ্গে আমাদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। কেবল খাদ্য হিসেবে নয়, শব্দ হিসেবেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আলুর বহুবিধ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক- কেউ যদি দেখতে নাদুসনুদুস হন, বন্ধুরা তাকে আদর করে ‘আলু’ বলে ডাকেন। আবার কেউ যদি একটু বোকাসোকা হন, তাকেও সবাই ‘আলু’ বলেই ডাকে। কাউকে হুমকি দেওয়া হলে বলা হয়- শয়তান, আজ তোকে মেরে একেবারে আলুভর্তা বানিয়ে ফেলব! ব্যর্থতার ক্ষেত্রে বলা হয়- সে পরীক্ষায় আলু পেয়েছে! ঠিক তেমনিভাবে সতর্কতার ক্ষেত্রে— কি রে, তুই তো দিন দিন একদম আলু হয়ে যাচ্ছিস! কম করে খা! রূপচর্চার ক্ষেত্রে- হায় হায়, তোমার চোখের নীচে তো কালি পড়ে গেছে। আলু বেটে চোখের নীচে লাগাও! দাম্পত্য কলহের ক্ষেত্রে- তোমার সংসারে এসে আলুভর্তা খেতে খেতে আমার জান তামা তামা! আঘাতের ক্ষেত্রে— ওরে বাপ রে, থামের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আমার কপালে আলু গজিয়ে গেল! ছোটবেলায় আমাদের প্রিয় ছড়া ছিল- রেলগাড়ি ঝমঝম, পা পিছলে আলুর দম! তবে সুস্বাদু হলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা সম্ভবত কাউকে আলুভর্তা বানানো!

আলুসংক্রান্ত প্রবাদ-প্রবচনে একটা খটকা আছে। আলু মাটির নীচে হয়। কিন্তু পটোল হয় মাটির ওপরে। ওই দিক থেকে আলু তোলা কঠিন, পটোল তোলা সহজ। কিন্তু আমাদের বাংলা প্রবাদে ‘পটোল তোলা’ বলতে মারা যাওয়া বোঝায়। কিন্তু আলু তোলা বলতে কেবলই আলু তোলা বোঝায়।

আলুর আরও নানা রকম মানে আছে। আছে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োগ। আলু বাংলার বিশেষ বিশেষ শব্দের অন্ত্য অঙ্গ, সহজ ভাষায় পাছা। এ যেমন- দয়া+আলু=দয়ালু, ঈর্ষা+আলু=ঈর্ষালু। অনুরূপ— নিন্দালু, নিদ্রালু, ঝগড়ালু, মায়ালু, চোরালু, পোড়ালু। সবজিকে যদি প্রথম আলু ধরা হয়, তাহলে এই শব্দের শেষে বসা দ্বিতীয় আলুও ভালোমন্দ সবখানে চলে।

বাংলা ভাষায় কিছু শব্দ আছে, যেখানে আলু সামনে বসে। যেমন- আলুবোখারা, আলুপুরি, আলুভর্তা, আলুথালু, আলুনি। আলুনিতেও আলু লাগে। আলুনির সঙ্গে আলুর সম্পর্ক নেই, লবণের সম্পর্ক। এত কিছুর পরও আলুর বদনামের শেষ নেই। আসলে, যে বেশি কাজ করে তার বদনামও বেশি হয়। আরও একটা আলু আছে, যে আলু পরের শব্দের সঙ্গে একটু ফাঁক রেখে বসে। এর নাম আলুর দোষ। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান মতে, ‘আলুর দোষ’ অর্থ লাম্পট্য, চরিত্রদোষ। কারও চরিত্রে দোষ থাকলে তা আলুর ওপর গিয়ে পড়ে। অনেকে এটাকে পেঁয়াজের দোষও বলে। আলু-পেঁয়াজ এক হলে অবশ্য জম্পেশ আলুর দম হয়ে যায়! সবাই আলু খায়, এজন্য সবার মধ্যে কমবেশি আলুর দোষ দেখা যায়। আলু কি আসলে খুব খারাপ জিনিস? এজন্যই কি চিকিৎসকরা আলু কম খেতে বলেন? নইলে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, সর্বপ্রিয় আলুকে লাম্পট্যের কাতারে নিয়ে যাবে কেন? নষ্টামি করে মানুষ, আর দোষ হয় আলু বা পেঁয়াজের। এজন্যই তো তাদের এত দাম!

মানুষের আলুর দোষ থাকতে পারে, আলুর কিন্তু তেমন দোষ নেই। আলুকে বলা হয় ‘কিং অব দ্য ভেজিটেবলস’। এর রয়েছে নানাবিধ মুখরোচক ব্যবহার। ফলে খাদ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। আর যে জিনিসের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা, সে জিনিসের দাম তো একটু বেশি হবেই!

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version