-->

নাটক মোদের অধিকার

রুখবে নাটক সাধ্য কার?

রেজানুর রহমান
নাটক মোদের অধিকার

নাটক মোদের অধিকার, রুখবে নাটক সাধ্য কার? স্বাধীন দেশে এই স্লোগানও দিতে হচ্ছে দেশের নাট্যকর্মীদের। আরও যেটা ভয়াবহ ঘটনা, তা হলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রধান ফটকের সামনে নাট্যকর্মীরা যখন প্রতিবাদ সমাবেশ করছিলেন, তখন প্রকাশ্যে তাদের উদ্দেশে ডিম-বৃষ্টি ছোড়া হলো। শুধু তাই নয়, যারা ডিম ছুড়লো নাট্যকর্মীদের সমাবেশে, তারাই কিছুক্ষণ পর বীরদর্পে ফিরে এলো শিল্পকলা একাডেমির সামনে। তারা এতটাই দুর্বিনীত ও মারমুখী হয়ে উঠলো যে, পারলে নাট্যকর্মীদের এখনই হত্যা করবে। কয়েক শত নাট্যকর্মীকে পাশে নিয়ে সমাবেশস্থলে দাঁড়িয়ে আছেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ, ঝুনা চৌধুরী, মলয় ভৌমিক, মাসুম রেজা, কামাল বায়েজীদ, আহসান হাবীব নাসিম, রওনক হাসানসহ অনেকে। নাট্যকর্মীরা স্লোগান তুললেন- নাটক মোদের অধিকার, রুখবে নাটক সাধ্য কার? সঙ্গে সঙ্গে নাটকের বিরুদ্ধে অবস্থানকারীরা পাল্টা স্লোগান দিল- অ্যাকশন, অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন। তারা সংখ্যায় মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ জন। অন্যদিকে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের কয়েক শত নাট্যকর্মী। নাটকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা সংখ্যায় অল্প হলেও চেহারায়, আচরণে অত্যন্ত দুর্বিনীত। দুপক্ষের পাল্টা-পাল্টি স্লোগান ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ালো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সামনে। সেনাবাহিনীর সদস্যসহ পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অনেক কষ্টে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলেন। নাটকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা একপর্যায়ে এলাকা ছাড়লো। কিন্তু রেখে গেলো অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা।

কেন নাটকের বিরুদ্ধে এমন অসৌজন্যমূলক, দুর্বিনীত প্রতিরোধ? যেন নাটকের কর্মীরা এই দেশের নাগরিক নয়। বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। সপ্তাহ খানেক আগে দেশ নাটকের আলোচিত প্রযোজনা নিত্যপুরাণ এর শো চলছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে। হঠাৎ একদল তরুণ শিল্পকলা একাডেমির প্রধান ফটকের সামনে দেশ নাটকের নাটক বন্ধ করার দাবিতে উচ্ছৃঙ্খল, দুর্বিনীত কায়দায় প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ স্বয়ং তার অন্যান্য সহকর্মী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হন। তিনি জানতে চান কেন নাটকের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ? বিক্ষোভকারীরা জানান, দেশ নাটকের একজন প্রভাবশালী সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সরকারের দায়িত্বে থাকা আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে আপত্তিকর চিত্র-সংবলিত স্ট্যাটাস দিয়েছেন। দেশ নাটক ফ্যাসিবাদের দোসর।

কাজেই তাদের কোনো কর্মকাণ্ড চলতে দেওয়া হবে না। এখনই মঞ্চের নাটক বন্ধ করে না দিলে তারা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আগুন ধরিয়ে দিবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়। এ পরিস্থিতিতে মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ শিল্পকলার মূল হলে ঢুকে মঞ্চে চলমান নাটক থামিয়ে দিয়ে বাইরের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে নাটকটি বন্ধ করার আহ্বান জানান। ফলে দেশ নাটক তাদের পরিবেশনা বন্ধ করে দেয়।

এটাই ছিল মূল ঘটনা। অন্যায়, অযৌক্তিকভাবে স্বৈরাচারী কায়দায় মঞ্চে নাটক বন্ধ করে দেওয়া হবে, নাট্যকর্মীরা এর কোনো প্রতিবাদ করবেন না, এটা তো ভাবা যায় না। ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ৮ নভেম্বর বিকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মূল ফটকের সামনে নাট্যকর্মীদের একটি সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে নাট্যজন মামুনুর রশীদ যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন অকস্মাৎ সমাবেশস্থলের সামনে থেকে একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক সমাবেশ লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও ডিম ছুড়তে থাকে। এ সময় সমাবেশে অংশগ্রহণকারী নাট্যকর্মীরা উত্তেজনায় ফেটে পড়েন। তাদের প্রতিরোধের মুখে উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা পালিয়ে যায়। সমাবেশের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়। প্রায় দশ মিনিট পর সেই যুবকেরা আবার সমাবেশের দিকে আসতে থাকে। ফলে সমাবেশস্থলে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। 'নাটক মোদের অধিকার, রুখবে নাটক সাধ্য কার'—এই স্লোগান দিতে থাকেন নাট্যকর্মীরা। উচ্ছৃঙ্খল সেই যুবকরা পাল্টা স্লোগান দিতে থাকে।

অ্যাকশন, অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন। ভারতের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান। দশ বারো হাতের ব্যবধানে দুপক্ষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলে সেনাবাহিনী ও পুলিশের একদল সদস্য মাঝখানে অবস্থান নেন। উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা সংখ্যায় অল্প হলেও তাদের ভাবভঙ্গি ও প্রতিবাদের ভাষা ছিল ভীতিকর। নাটক কেন বন্ধ করতে হবে, এর কোনো সদুত্তর তারা দিতে পারেনি।

ঘটনার পরের দিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কারা নাটক বন্ধ করে দিতে চাইছে, নাটক বন্ধ করতে কারা শিল্পকলা একাডেমির সামনে বিক্ষোভ করছে, নাট্যকর্মীদের সমাবেশে হামলা করেছে, তাদের পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ বলেন, "আমরা নাট্যকর্মী, আমাদের পরিচয় স্পষ্ট। যারা নাটক বন্ধ করতে চাইছে, তারা কারা? তাদের পরিচয় আমরা জানতে চাই। যেভাবে আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে, তা সন্ত্রাসী আচরণ। এই সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় এনে শিল্পচর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।"

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ষষ্ঠ তলায় সেমিনার কক্ষে যখন সংবাদ সম্মেলন চলছিল, তখন শিল্পকলার মূল গেটের সামনে উচ্ছৃঙ্খল কিছু যুবক প্লাকার্ড হাতে নাটকবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিল। একপর্যায়ে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থল থেকে দুজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

উদ্বেগজনক এ ঘটনায় শুধু মঞ্চ নাটক নয়, রাজধানীতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও কোন সাহসে একটি পক্ষ নাটকের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে, তা বেশ রহস্যজনক। আশার কথা, দেশের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক, সংস্কৃতিজন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সংস্কৃতি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই মঞ্চ নাটকসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ নেবেন, এই প্রত্যাশা সবার।

লেখক: সম্পাদক -আনন্দ আলো।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version