ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে ইতোমধ্যে সে সরকার তিন মাসের বেশি সময় পার করে ফেলেছে। নতুন সরকারের এই পুরো সময় জুড়েই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট প্রচেষ্টা চোখে পড়েছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এই আক্রমণের ঘটনা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরই বেশি ঘটছে। ঘটনা এর বাইরেও ঘটছে। যেমন সেপ্টেম্বরে পাহাড়ে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি এবং পাহাড়িরা মুখোমুখি অবস্থানে চলে গিয়েছিল। এসব ঘটনা ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিচয়, জাতিগত পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়- সব পরিচয়ের কারণেই হামলার ঘটনা ঘটেছে।
গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত হামলার শিকার সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৬৮। হামলার ঘটনা এর পরেও ঘটেছে। এসব কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে কট্টরপন্থিরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার লক্ষে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশের সব ধর্মাবলম্বীকে নিয়ে একটি সুন্দর দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন, সব ধর্মের মানুষ মিলে একটি সুন্দর দেশ গড়তে চাই। ৮ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে কঠিন চীবর দান ও বৌদ্ধ মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের একদিন পরেই ইসলামী ফাউন্ডেশন খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম রুহুল হোসেন বলেন, দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে একটি পক্ষ চেষ্টা করছে। এমনটি কোনোভাবেই হতে দেওয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধরে রাখার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জাতি-ধর্ম পরিচয়ভিত্তিক সহিংসতা কমাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর এ ধরনের সম্প্রীতি বাড়াতে সামাজিক প্রকল্প নিতে হবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। এর পাশাপাশি, দায়িত্ব নিয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সংখ্যাগুরুরা নিজেদের স্বার্থেই সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াবে। কারণ বহুত্ববাদের ধারণা থেকে রাষ্ট্র একবার সরে এলে সেটি ফিরিয়ে আনা শুধু কঠিনই হবে না অসম্ভব একটি কাজও হবে।
মূলত সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিল। আর সে কারণে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েকদিন পরেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকার লালবাগে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শন শেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বলেছিলেন, ‘বড় রকমের একটা বিভেদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এমন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাচ্ছি, যেটা একটা পরিবার, এটাই হচ্ছে মূল জিনিস। এই পরিবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা, বিভেদ করার প্রশ্নই আসে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশি।’ তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া আশ্বাসে আশ্বস্ত হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
মুক্তিযুদ্ধের পর এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় মানুষ নতুন দেশে সমধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন। অন্য সম্প্রদায়ের তুলনায় মুক্তিযুদ্ধে তারা ত্যাগও বেশি স্বীকার করেছেন। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় পরও আমাদের সামনে এখন একটি প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আসলে তাদের এখনো এই দেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে পারছি কিনা? পরিসংখ্যান বলছে, পাকিস্তান আমল তো বটেই, স্বাধীন বাংলাদেশেও অধিকাংশ সময় সংখ্যালঘুদের কাটাতে হয়েছে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করার চেষ্টা করেছে। কখনও বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা কখনও সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচারের মাধ্যমে তারা একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতার সুযোগে একটি স্বার্থান্বেষী মহল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছেন। মূলত পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর থেকে তারা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছেন। তারপর সামরিক বা বেসামরিক লেবাসে যারাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছেন, তারা শুধু যে সংবিধানকে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে আবদ্ধ করেছিলেন তা নয়, মাইনরিটি ক্লিনজিং প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত করে গেছেন।
দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক আছে প্রায় দেড় কোটি। গত ৫০ বছরে দেশে মোট জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারির পর থেকে এখন পর্যন্ত জনসংখ্যা যে হারে বেড়েছে, সেটাকে মানদণ্ড ধরলে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ কমেছে। তবে এই সময়ে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যার হার মোটামুটি একই আছে।
পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যে দেশের জনসংখ্যা আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার চাইতে কম। এই বিরাট জনগোষ্ঠীর মেজরিটিই এখন শভিনিজমের বলি। আগে আড়ালে-আবডালে বলা হলেও এখন মুখের সামনেই তাদের বলা হয় ‘মালাউন’।
বহু বছর ধরে আমরা দেখছি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন ও উচ্ছেদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য দল একযোগে কাজ করে। দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করা হয়। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরও এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। দিনে দিনে আক্রান্ত হতে হতে তাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে।
এটা পরিষ্কার যে একাত্তরের পরাজিত শক্তি সংখ্যালঘু হ্রাসকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে একটি সংকট তৈরি করতে চায়। কারণ তারা ভাবছে, যদি সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করাও সহজতর হবে। মূলত এসব কারণে দেশের জনসংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে না। ২০০১, ২০১১, সালের আদমশুমারির জেলাভিত্তিক তথ্য পাশাপাশি রাখলে দেখা যায়, ১৫টি জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা কমে গেছে। জনসংখ্যাবিদদের মতে, এটি ‘মিসিং’ পপুলেশন বা ‘হারিয়ে যাওয়া মানুষ’। এরা কেন হারিয়ে গেল? কেন নীরবে দেশত্যাগ করার কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে অবিশ্বাস্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ল সেটা নিয়ে কেউ কি ভেবেছে?
বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো হোক সেটা আমরা কেউই চাই না। দেশটিতে একদিকে যেমন সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া সফলতার সঙ্গে সমাপ্তির পথে একইভাবে সংখ্যাগুরুরাও নিজেরা নিজেরা মারামারি করছে। সেখানে শিয়ারা সুন্নিদের মারছে, আর সুন্নিরা মারছে শিয়াদের। আর সবাই মিলে হত্যা করছে মানবতাকে। বাংলাদেশেও যাতে সেই পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, সে জন্য এখনই আমাদের সজাগ হওয়া উচিত।
জাতিধর্ম পরিচয়ভিত্তিক সহিংসতা কমাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর এ ধরনের সম্প্রীতি বাড়াতে সামাজিক প্রকল্প নিতে হবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। এর পাশাপাশি, দায়িত্ব নিয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সংখ্যাগুরুরা নিজেদের স্বার্থেই সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াবে। কারণ বহুত্ববাদের ধারণা থেকে রাষ্ট্র একবার সরে এলে সেটি ফিরিয়ে আনা শুধু কঠিনই হবে না অসম্ভব একটি কাজও হবে।
বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেনাবাহিনীর ভূমিকার কারণে শুরুর সেই ‘ভয়াবহ অস্থিতিশীল’ পরিবেশ কাটিয়ে বর্তমানে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে দেশে। এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও তুলনামূলক নিশ্চিন্তে আছে। ফলে আমরা সেনাপ্রধানের প্রত্যাশা আর দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভূমিকাতেই আস্থা রাখতে চাই। কারণ, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার মূল দায়িত্ব এখন তাদের উপরেই অর্পিত।
সাম্প্রদায়িক শক্তি যেভাবে বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছিল— ওই সময় সেনাবাহিনী শক্ত হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে দেশের অবস্থা যে আরও খারাপ হতো সেটা সাদা চোখেই বোঝা যায়। সাম্প্রদায়িক সে শক্তিকে দমন করে সম্প্রীতি রক্ষায় সেনাবাহিনীর এই ভূমিকা প্রশংসনীয়। তাই সেনাপ্রধানের সঙ্গে আশাবাদী হয়ে আমরাও এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখি— যেখানে সব ধর্মাবলম্বী মানুষের সমন্বয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ সম্ভব হবে।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য