-->

ধূমপান রোধে চাই শক্তিশালী আইন

এবিএম জুবায়ের
ধূমপান রোধে চাই শক্তিশালী আইন

পরোক্ষ ধূমপান মৃত্যু ঘটায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ অকালে মারা যায়। সাধারণত যখন কেউ নিজে সরাসরি ধূমপান না করেও অন্যের ধূমপান থেকে নির্গত ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে, সেটিকেই পরোক্ষ ধূমপান বলা হয়ে থাকে।

তামাকপণ্যের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নিরাপদ কোনো মাত্রা নেই। তামাকের ধোঁয়ায় রয়েছে ৭,০০০টি রাসায়নিক পদার্থ, যার মধ্যে ৭০টি ক্যানসার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস ক্যানসার, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান।

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে বলে আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির সহযোগিতায় পরিচালিত ‘দ্য ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ : এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে। ওই একই গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ১শ কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে ‘স্মোকিং জোন’ বা ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা (ডিএসএ) রাখার ব্যাপক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেখানে তরুণদের আনাগোনাই বেশি। যখন কেউ দরজা খুলে এসব স্মোকিং জোনে প্রবেশ করে বা বের হয় তখন সিগারেটের ধোঁয়া পুরো রেস্তোরাঁয় ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে আগত নারী, শিশুসহ সবাই পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির শিকার হয়। শুধু তাই নয়, এসব রেস্তোরাঁয় যেসব কর্মী রয়েছে তারা সেবা দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে থাকে। বেসরকারি সংস্থা ভয়েস পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক কোম্পানিগুলো নগদ টাকা ও সরঞ্জামাদি প্রদানের মাধ্যমে রেস্টুরেন্টগুলোতে স্মোকিং জোন স্থাপনে উৎসাহিত করে থাকে।

‘সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিলড্রেন: আ সার্ভে ইন ঢাকা, বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আশপাশ এলাকার ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিন পাওয়া গেছে। পরোক্ষ ধূমপান শিশুর দেহে নিকোটিন উপস্থিতির কারণ বলে এই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

জনস হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ এবং গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ঢাকা শহরের আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে যেখানে ৮ শতাংশ স্থানে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা বা ডেজিগনেটেড স্মোকিং এরিয়া (ডিএসএ)’ পাওয়া গেছে, যার একটিতেও পরিপূর্ণভাবে আইন মেনে ডিএসএ রাখা হয়নি। গবেষণার উপসংহারে বলা হয়েছে, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা (ডিএসএ) অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপানের ছোবল থেকে সুরক্ষা প্রদান করতে পারে না এবং এই বিধান চালু রেখে ধূমপানমুক্ত আইন বা নীতির সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।

বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে শর্ত সাপেক্ষে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা বা স্মোকিং জোন রাখার সুযোগ রয়েছে। এটি জনস্বাস্থ্যবিরোধী একটি বিধান। সুতরাং শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে ডিএসএ বাতিল করা প্রয়োজন। শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে থাইল্যান্ড, নেপাল, তুরস্ক, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ৭৪টি দেশে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার বিধান বাতিলসহ পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে, যেখানে সব পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার বিধান বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।

তামাক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বর্তমানে ৩৫.৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করেন। তামাকের ভয়াবহতা হ্রাসে বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তি ডব্লিউএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-তে স্বাক্ষর করে। এটি প্রতিপালনে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এফসিটিসি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে এফসিটিসি বাস্তবায়ন তথা তামাক নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের জন্যও একটি অগ্রাধিকার। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বেশ কিছু দুর্বলতা এসডিজি অর্জনে বাধা হিসেবে কাজ করছে।

পরোক্ষ ধূমপান রোধে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা স্মোকিং জোন রাখার বিধান বাতিলসহ এফসিটিসি-এর আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি। নারী, শিশুসহ সবাইকে তামাকের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষায় জনস্বাস্থ্যের নিরিখে এটি হবে সর্বোত্তম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা।

মন্তব্য

Beta version