আমাদেও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা ও উদ্বিগ্নের যেন শেষ নেই। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেওয়া হচ্ছে না নিয়মিত ক্লাস, শিক্ষার্থীরা আগের মতো ক্লাসে ফিরছে না। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে বই বিতরণ উৎসবেব আর মাত্র ৪৪ দিন বাকি। অথচ প্রাথমিকের বই মুদ্রণের কাজ শুরু হলেও মাধ্যমিকের ও মাদরাসার বই ছাপার এখনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে গতকাল দৈনিক ভোরের আকাশে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে এই বিপুল পরিমাণ বই ছাপা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছরের প্রথমদিন শিক্ষার্থীরা অর্ধেক বই পাবে না বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে রাজধানীর ঢাকা সিটি কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলেও অপর একটি কবরে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ওই কলেজের ১১ হাজার শিক্ষার্থীর ভাগ্য এখন অনিশ্চিয়তার পথে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ তা আমরা মনে করি না। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় বলা যায়, দেশের শিক্ষার মান, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান এখন তলানিতে নেমেছে। আমাদের উচ্চশিক্ষার দুর্গতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি পদত্যাগ করেন। তারা এসব দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের মূল পদ শিক্ষকতায় ফিরে গেছেন। কিন্তু এর জের ধরে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের প্রধানদেরও পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়। এই পদত্যাগে বাধ্য করানোতে অংশ নেয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন রাস্তায় নেমে আসার ঘটনায় শিক্ষাঙ্গনের শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে।
অনেকের মতে, শিক্ষাপ্রশাসন এখনো ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয়নি। ফলে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায়ও তেমন পরিবর্তন আসেনি। আন্দোলনসহ নানা কারণে শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এ ধরনের সংকট নতুন নয়। এ ধরনের সংকট বা সৃষ্ট অবস্থা যে শিক্ষার জন্য ক্ষতিকর, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এটিও মানতে হবে যে দলাদলি শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেছে। শিক্ষকরা দলাদলি করেছেন, এমন অভিযোগও নতুন নয়।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটি অরাজকতা। এতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। তাদের পরস্পরের প্রতি আস্থা নেই। এতে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের সম্মানবোধও থাকবে না। অটো প্রমোশন, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস এগুলো সমাধান নয়। অন্যদিকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অসহায়ত্বের সুযোগে দৌরাত্ম্য বেড়েছে প্রাইভেট-কোচিংয়ের। অন্যদিকে বিনামূল্যের ৩৫ কোটি বই এখনো ছাপার বাকি। প্রতিবছর সাধারণত জুলাই-আগস্ট থেকে পাঠ্য বই ছাপার কাজ শুরু হয়। এরপরও ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু এ বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এনসিটিবিতে অনেক পরিবর্তন আসে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, সদস্য ও অন্য কর্মকর্তারা বদলি হন। এরপর আবার নতুন শিক্ষাক্রম বদল করে আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া হয়। পাঠ্যক্রমেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ বছর পাঠ্য বইয়ের কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। এরপর আবার পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করতে অনেক সময় চলে গেছে। ফলে যথাসময়ে বই ছাপার কাজ শুরু করতে পারছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা ব্যবস্থার এই বেহালদশার বিষয়টি দুঃখজনক ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
আমরা মনে করি, দেশের উন্নয়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। যে জাতি যত শিক্ষিত সেই জাতি তত উন্নত। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে সেই দৃষ্টান্তই আমরা দেখতে পাই। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস নেমে এসেছে সেইদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে । আমরা চাই, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসুক। একই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলাও ফিরাতে হবে। নিয়মিত ক্লাস নিতে হবে। ছাত্রদেরকে রাজনীতিতে উৎসাহিত না করে লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের আন্দোলন। একই সঙ্গে যথাসময়ে বিনামূল্যের বই ছাপার কাজ শেষ করে নির্ধারিত সময়ে যাতে শিক্ষার্থীরা বই পায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান সরকার সেইলক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুখে হাসি ফোটাবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য