টাকার মূল্য যখন বেশ কমে যায় অথবা অন্য মুদ্রার কাছে টাকা যখন ধরাশায়ী হয় তখনই বোঝা যায় দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা কতটা! গত ১৯ নভেম্বর সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ অর্থনীতির দুরবস্থার কথা জানালেন। দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভয়াবহ! লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে পর্যুদস্ত করে রেখে যাওয়া দেশের সকল খাতের কথাই বললেন তিনি। ব্যাংক খাতের দুরবস্থার কথা বলেছেন বিশেষভাবে। তবে কোনো ব্যাংক বন্ধ করা হবে না, জানালেন সেটাও।
ওদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে চরম হতাশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে যোগদানের পরপর তিনি দেশের ১০টি ব্যাংকের চরম দুরবস্থার কথা বলেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের দেড় মাসের মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ে উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। কিন্তু দেশের অতি দুর্বল ব্যাংকগুলো নিয়ে দুঃচিন্তা কমছেই না। কদিন আগে তিনি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ও ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার করেছেন।
১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করার অভিযোগ দেশের আলোচিত একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েস ও সংঘবদ্ধ অপরাধের মাধ্যমে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ এনেছে ২ মাস আগে।
অর্থনীতির প্রাণশক্তি হচ্ছে ব্যাংকিং খাত, যা বেশ নড়বড়ে অনেকদিন থেকেই। অর্থপাচার, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং দেশের আমদানিনির্ভর অর্থনীতি এর মূল কারণ। এসব কারণে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে বারবার। বৈদেশিক লেনদেনে অন্যান্য মুদ্রার সুবিধা থাকলেও মার্কিন ডলারকেই আমরা প্রাধান্য দিয়ে আসছি। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মুদ্রা মার্কিন ডলারের ওপর চাপ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে বিগত সরকার। ফলে ডলার তেজি হয়ে উঠেছে দিনের পর দিন।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক মুদ্রার ব্যাপক ব্যবহারের এখন সময়ের দাবি। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ডলারের পাশাপাশি রুপিতেও বাণিজ্য চলছে। দুই দেশের বাণিজ্যে টাকা-রুপিতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। নিজস্ব মুদ্রায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের দর বাড়ছেই আর দরপতন হচ্ছে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মুদ্রার। বছরখানেক আগে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ভারতীয় মুদ্রা রুপিকে নতুন গুরুত্বে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। নিজস্ব মুদ্রাকে শক্তিশালী করার বিষয়ে রাশিয়ার উদাহরণটিকে অনুসরণ করতে চায় ভারত। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে রাশিয়া। তখন বিকল্প পথ বের করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন ঘোষণা করেন, ইউরোপের দেশগুলো যদি রাশিয়া থেকে গ্যাস নিতে চায়, তাহলে ইউরো বা ডলার দিলে হবে না, দিতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবল। পুতিনের কাছে হিসাব ছিল পরিষ্কার। সেটা হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে রাশিয়া থেকে। এ দাওয়াই কাজে দেয় এবং রুবলের মান বাড়তে থাকে। মার্কিন ডলারের আধিপত্যের বাইরে ভারতও রাশিয়ার পথ অনুসরণ করছে। রাশিয়া, মরিশাস, ইরান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারত রুপিতে বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। এর আগে বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ষাটের দশকে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান— এসব দেশ ভারতীয় রুপি গ্রহণ করত। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ভারত প্রায় ১৮টি দেশের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য তৎপরতা পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রুপিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উদ্যোগের পেছনে চারটি কারণ নিহিত। প্রথমত, ডলার সংকটে রয়েছে দেশ দুটি। ফলে উভয়েই এতে লাভবান হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের দুবার মুদ্রা বিনিময় করার খরচ কমেছে। তৃতীয়ত, লেনদেন নিষ্পত্তিতে সময় বাঁচে। চতুর্থত, অন্য উদ্বৃত্ত মুদ্রা রুপিতে রূপান্তর করে লেনদেন নিষ্পত্তিতে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আমদানি-রপ্তানির বৃহৎ বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্যই আমদানি হয় ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থবছরে। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও একই প্রবণতা দেখা গেছে।
অর্থনীতির পরিভাষায়, ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটাকে ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’ বলা হয়। আর্থিক খাতে এ ধরনের মুদ্রা বিনিময়কে একটি কৌশলগত পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মুদ্রাকে শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে টাকা ও রুপি ব্যবহারের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য বৃহত্তর উদ্যোগ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। দ্বিতীয় পর্যায় কাজ হবে রুপি ও টাকার চাহিদা ও যোগানে ভারসাম্য রক্ষা করা। যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য রুপির চাহিদা বেশি ও যোগান কম, তাই ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে যোগান বৃদ্ধির সহজতর উপায় নিয়ে। যোগান বৃদ্ধির সহজতর উপায় হলো বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি আমদানি করা এবং যারা রুপিকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করছে না, তাদের নিকট থেকে আমদানি যথাসম্ভব কমিয়ে দেওয়া। অনেক বিশ্লেষক ইতোমধ্যে এ প্রক্রিয়াকে নিরুৎসাহিত করেছেন এবং বলেছেন, এ ধরনের বিনিময় সফল হবে না। সত্য হলো, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ ভ্রমণ ও চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়। এ ধরনের ভ্রমণের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয় অন্যদিকে ভারত থেকে অনেক শিক্ষার্থী মেডিকেল শিক্ষার জন্য বাংলাদেশে পড়তে আসে। ভারতের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া আরও সহজতর করা প্রয়োজন। এর ফলে বাংলাদেশে রুপির যোগান কিছু হলেও বৃদ্ধি পাবে। ডলার এনডোর্স করার বিপরীতে রুপির ব্যবহারের সুযোগ থাকায় ভারতীয়দেরও মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য দুই দেশের মুদ্রায় সহজে বিনিময় সম্ভব এমন একটি প্লাস্টিক কার্ড অর্থাৎ ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করাও একান্ত প্রয়োজন। অর্থাৎ বিনিময় ও বাণিজ্যকে যত বেশি সহজতর করা হবে তত বেশি দুই দেশের মধ্যে রুপি ও টাকার বিনিময় বৃদ্ধি পাবে এবং চাহিদা ও যোগানে সামঞ্জস্যতা থাকবে।
অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক গতিতে ধরে রাখা, কারণ অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি দুই দেশের মুদ্রা বিনিময়কেও অস্থির করে তুলতে পারে; তখন আবার সবাই ডলারে ফিরে যেতেই পরামর্শ দেবে এমনটি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
কয়েক বছর আগে ভারত বাংলাদেশি কিছু পণ্যে শুল্ক উঠিয়েছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ভারতে এক বিলিয়ন ডলার পৌঁছেছিল। আশা করা হচ্ছিল, এটি দুই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে খুব দ্রুত। এক্ষেত্রেও ভারতে ছোট ও বড় পরিসরের যেসব পণ্যভিত্তিক পরোক্ষ রপ্তানি বাধা রয়েছে সেগুলো তুলে দেয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চীন ২০২০ সালের জুলাই থেকে ট্যারিফ লাইনের আওতায় ৯৭ শতাংশ (আগের ৬১ শতাংশ) বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু করেছে। সেক্ষেত্রে ভারতও রপ্তানির বিষয়ে শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে। ভারত পাট, পাটজাত পণ্য, বাংলাদেশে তৈরি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও মাছ ধরার জালের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশের কিছু খাতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব অ্যান্টি ড্যাম্পিং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাণিজ্য বাধা তুলে দেওয়ার মাধ্যমে রুপি সোয়াপের পথ সুগম করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত যেকোনো মুদ্রার একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি অবশ্যই সহজে পাওয়া যাবে।
ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীন, মালেয়শিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য, পর্যটন, চিকিৎসা খাতে যোগাযোগ বেশি। এসব দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ওই দেশের মুদ্রা যেমন রুপি, রিঙ্গিত, বাথ ইত্যাদি পাসপোর্টে এনডোর্স করিয়ে নেওয়া উচিত। ওই সুবিধাও রয়েছে জানালেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক পিএলসি প্রধান কার্যালয়ের ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের উপমহাব্যবস্থাপক ফজলুল কবীর। তিনি জানান, মার্কিন ডলারের ওপর চাপ কমাতে দ্বিপাক্ষিক মুদ্রায় গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
এছাড়াও ডলারের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা অনেক। যেমন- পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে এনে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি করা, অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি হ্রাস করা, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানো, দ্বৈত নাগরিকগণ যাতে বিদেশে অর্থ না নিয়ে যেতে পারে ওই ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েস ও সংঘবদ্ধ হুন্ডি কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।দ্বিপাক্ষিক মুদ্রায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও পর্যটনে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। একচেটিয়া একটি মুদ্রাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমাদের আমাদানিনির্ভর বাণিজ্যের শোচনীয় অবস্থা দৃশ্যমান। ফলে দেশে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশে পৌঁছেছে যা ভোক্তা সাধারণের কাছে অসহনীয়। অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণও মার্কিন ডলারের চাহিদা।
লেখক: সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য