আমাদের সমাজব্যবস্থায় এমন কোনো সেক্টর বা বিভাগ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি নেই। এমনকি দুর্নীতি ছাড়া ভালো কিছু পাওয়ারও আশা করা যায় না। সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বেঁধে বসেছে। এই দুর্নীতির কালো থাবায় সমাজে বাড়ছে অশান্তি ও অপরাধপ্রবণতা। নানা অপরাধে জর্জরিত হয়ে পড়ছে দেশ ও জাতি। লুটপাট ও পাচার হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের টাকা। সেই টাকা ফেরত আনারও কোনো সুযোগ মিলছে না। ফলে অর্থনৈতিক দৈন্যতায় ভুগছে ব্যাংকগুলো। এই দুর্নীতির কারণেই অস্থিরতা বিরাজ করছে বাজার ব্যবস্থায়। সিন্ডিকেট চক্র দখলে নিয়েছে বাজার ব্যবস্থা। ফলে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। চড়া দামে নিত্যপণ্য ক্রয় করে প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন নিম্ন আয়ের মানুষজন। অথচ এ নিয়ে প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই।
দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে টিসিবি চালু করা হলেও সবার ভাগ্যেও তা মিলছে না। টিসিবির কার্ড পেতেও চলছে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। শিক্ষা ক্ষেত্রে চলছে ভর্তি বাণিজ্য। শিক্ষার নামেও চলছে বাণিজ্য। এতে কোচিং বাণিজ্য যেন জমজমাট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলে শেষ করা যাবে না। রোগীদের জীবন বাজি রেখে চিকিৎসকরা আদায় করে নিচ্ছেন অতিরিক্ত অর্থ। চিকিৎসা বাণিজ্যের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ বরাবরই বঞ্চিত হচ্ছেন উন্নত ও ভালো চিকিৎসা সেবার সুযোগ থেকে। আর চাকরির সুযোগের কথা বলাই বাহুল্য, টাকা ছাড়া কোথাও চাকরি পাওয়া যেন দুষ্কর বিষয়। ঘুষ না দিলে সরকারি চাকরি মিলছে না কারও ভাগ্যে। দুর্নীতিবাজরা আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে, তা পিয়ন কিংবা ছোট্ট কোনো কর্মচারীর সুযোগই হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দিতে হয় ঘুষ। তা না হলে চাকরির আশা করা যায় না।
অতীতে এই দেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড রেখেছে। রাজনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা, চাকরিসহ সবকিছুতেই চলছে দুর্নীতি। অথচ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এই স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে ৩০ লাখ বাঙালি তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, ২ লাখ মা ও বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা যেন আজ শোষণ ও দুর্নীতির কারণে ভুলুণ্ঠিত হওয়ার পথে।
তাই বলা চলে, প্রাত্যহিক জীবনে দুর্নীতি যেন আমাদের প্রতিটি জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। বর্তমানে এমন খাত খুব কমই আছে যেখানে দুর্নীতির স্পর্শ নেই। ক্ষুদ্র হোক বা বৃহৎ, সব দুর্নীতিই দুর্নীতি। শুধুমাত্র বাংলাদেশই নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বেও দুর্নীতি চিরপরিচিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
আমাদের দেশে কিছুদিন পরপর শীর্ষ দুর্নীতিবাজের খবর বের হয়। কিন্তু এই খবরের কোনো ইতিও দেখা যায় না। বাংলাদেশের সব শ্রেণিতেই কমবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ বিদ্যমান। কেউ হয়তো কম, কেউ একটু বেশি। কেউ ট্যাক্স ফাইলে কম ট্যাক্স দেওয়ার জন্য দুর্নীতি করে। কেউ রাজউকের প্ল্যানের বাইরে বাড়ি বানিয়ে দুর্নীতি করে। কেউ জমি-ফ্ল্যাটের দাম কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন খরচ কমাতে দুর্নীতি করে। কেউ বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে দুর্নীতি করে। কেউ হাসপাতালে বেড পেতে দুর্নীতি করে। কেউ বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস বিলে দুর্নীতি করে। কেউ অফিস ফাঁকি দিয়ে দুর্নীতি করে। কেউ পদোন্নতি বা পদায়নে দুর্নীতি করে। কেউ টকশোতে ডাক পেতে দুর্নীতি করে। কেউ নিজের সৃষ্টি প্রকাশ করতে দুর্নীতি করে। কেউ সরকারি খরচে হজে যেতে দুর্নীতি করে। কেউ পুরস্কৃত হতে দুর্নীতি করে। এমনকি রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারগুলো জিতে নিতেও ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়।
দুধওয়ালা দুধে পানি মিশিয়ে দুর্নীতি করে। দোকানদার ভালো নোটের মধ্যে ছেঁড়া নোট দিয়ে দুর্নীতি করে। জন্ম নিবন্ধন থেকে শুরু করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট অফিসে যে কী পরিমাণ দুর্নীতি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যে বড়, সে বড় লেভেলের দুর্নীতি করে। যে ছোট, সে বড় লেভেলের দুর্নীতি করতে পারে না বলে ছোট লেভেলের দুর্নীতি করে।
সবাই কেবল অন্যের দুর্নীতির সমালোচনা করে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য যে ঈমান ও সততার দরকার, তা কারও মধ্যে নেই। এ দেশের সিস্টেমটাই এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, দুর্নীতিতে না জড়িয়ে কোনো উপায় থাকে না। দুর্নীতি না করলে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
দুর্নীতি এড়াতে টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য দরকার ‘স্বচ্ছ প্রশাসন’। আর সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও সমৃদ্ধির সকল সুযোগ এবং সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে তখনই, যখন জবাবদিহিতামূলক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে মানুষকে নৈতিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে আমাদের এই অভ্যাস। সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ যেন সে অনুসরণ করে চলে। তার যেন সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য থাকে। আমি মনে করি, দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্র নিষ্ঠা খুবই দরকার। এজন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই অঙ্গীকারকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য