দীর্ঘ দেড় যুগের লাগাতার জালিয়াতি ও লুটপাটের কারণে দেশের ১০ ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট ও বিদেশে টাকা পাচারের কারণে এ সময়ে অন্তত এক ডজন ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষত, তারল্য সংকটে বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে এসব ব্যাংক। মূলত কয়েকটি গ্রুপ বিদেশে লুটপাট আর বিদেশে অর্থ পাচার করে বিপাকে ফেলে দিয়েছে ব্যাংক খাতকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। একই সঙ্গে বীমা খাতও ধ্বংসের মুখে পড়েছে বলে গতকাল দৈনিক ভোরের আকাশে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে দেশের বীমা খাত এখন ধ্বংসের মুখে পড়েছে। বর্তমানে দেশে ৮২টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে ২৯টিতেই তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও মর্মান্তিক বলে আমরা মনে করি। এই অর্থনৈতিক খাতকে এখনি ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে আমরা মনে করি।
বিগত দেড় দশকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও শিল্পগ্রুপের লুটপাটের কারণে দুর্বল হওয়া এসব ব্যাংককে বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল হয়ে পড়া এসব ব্যাংককে আরও বেশি তারল্য সহায়তা দিতে সবল ব্যাংকগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তারল্য সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য আমানত সংগ্রহ করার ওপর জোর দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এর আলোকে ইতোমধ্যে চড়া সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। চালু করেছে আকর্ষণীয় মুনাফার সঞ্চয় প্রকল্প। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্র জানায়, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক ঋণ আদায়ে জোর দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা ইতোমধ্যে বেশকিছু সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১০টি সবল ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এসব ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য থাকায় তারা সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ধার দিয়েছে। এসব ধার বা ঋণে গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ঋণ সুবিধা পেয়েও এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারছে বলে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে না। গ্রাহকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। ফলে সংকটও কমছে না। ব্যাংকের এই দুরবস্থা কোনোভাবেই চলতে দেয়া যায় না।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জর্জরিত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকট উত্তোরণে কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকখাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠনও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ ছয়জনকে সদস্য করা হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক করা হয়েছে। সরকার ওই ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর পাশে দাঁড়াতে রাজি হয়েছে সোনালী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক।এতে করে অচিরেই ব্যাংকগুলোর এই দৈন্যদশা নিরসন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একইভাবে বীমা খাতকেও বাঁচাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
আমরা চাই, দেশের ব্যাংক ও বীমার এই দুরবস্থা দ্রুত নিরসন হোক। ব্যাংক ও বীমা অচল হলে দেশ অচল হবে সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরকে চাঙ্গা করতে হলে ব্যাংক ও বীমাকে আগে সচল করতে হবে। পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ব্যাংক ও বীমা হচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার মূল চালিকা শক্তি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো অচল হয়ে পড়লে দেশের অর্থনীতিতেই ভেঙে পড়বে। দেশে অচল হয়ে পড়বে অর্থনীতির চাকা। তাই ব্যাংক ও বীমা খাতকে বাঁচাতে সরকার পরিকল্পিত উদ্যোগ নিবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা ও দাবি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য