-->

অহিংস আন্দোলনের পাঠ নেবে কি শিক্ষার্থীরা?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
অহিংস আন্দোলনের পাঠ নেবে কি শিক্ষার্থীরা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার জন্য দীর্ঘদিন দাবি করছেন। ওই দাবিতে প্রায়ই তারা রাস্তাঘাট অবরোধ করছেন। কলেজের ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে আন্দোলন করছেন। ওই আন্দোলনের ফলে একদিকে যেমন কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে; অন্যদিকে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়ছে। এমনিতেই অফিসগামী ও অফিস ফেরত যাত্রীদের যানজটে নাকাল হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজপথে বসে থাকতে হয়। তার উপর ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে জনজীবনে ওই দুর্ভোগ সহ্যর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

গণমাধ্যমে দেখলাম, ঢাকার তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে ট্রেনে হামলার ফলে শিশু-কিশোর আহত হয়েছে। আহত হওয়ার ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার সারাবিশ্বে স্বীকৃত। তবে বাংলাদেশের মতো প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে যেমন দেখা যায় বিশ্বের অন্য কোথাও অমনটি দেখা যায় না। উন্নত বিশ্বের সভ্য সমাজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্যুভিত্তিক জনদাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা অহিংস আন্দোলন করেন। তারা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান, মানববন্ধন করেন, স্মারকলিপি দেন এবং তাদের দাবির পক্ষে জনসংযোগ করেন। শিক্ষার্থী কর্তৃক দাবি আদায়ে সহিংস হয়ে ওঠা বা বলপ্রয়োগের ঘটনা খুব কদাচিৎ ঘটে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন করেছেন। ওই আন্দোলন অধিকাংশ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ছিল এবং জনসমর্থন পেয়েছেন। দুই এক জায়গায় অবশ্যই আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। তবে ওই সহিংস আন্দোলন ইউরোপ আমেরিকার সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজ-বুদ্ধিজীবীদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সহিংসতাকারীদের গ্রেপ্তার করেছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অধিকার যেমন রয়েছে তেমনি কেউ সহিংস হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের চিত্রও আমরা উন্নত বিশ্বে দেখি। কিন্তু বাংলাদেশে আন্দোলনের নামে সহিংসতায় জড়ালে কারোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা খুব কমই চোখে পড়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করলেও শেষ পর্যন্ত তারা মুক্তি পায়। ফলে তাদের সহিংস আচরণের কোনো বিচার হয় না। সেই কারণে বাংলাদেশের আন্দোলনগুলো সহিংস হয়। কারণ আন্দোলনকারীরা জানে জান মালের ক্ষতি করলেও শেষপর্যন্ত তাদের কিছু হবে না।

কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা নিয়ে আমরা আন্দোলন দেখছি। জগন্নাথকে তিতুমীর কলেজের মা বলা যায়, কারণ যে পাকিস্তান আমলে ১৯৬৮ সালে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি স্তর ছাঁটাই করে আয়ুবশাহীর সামরিক সরকার জিন্নাহ কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জিন্নাহ কলেজকে তিতুমীর কলেজ নামকরণ করা হয়। সেই কারণে জগন্নাথের আন্দোলনের জিন তিতুমীর কলেজেরও আছে। কিন্তু আন্দোলন সবসময় যে মানুষের কল্যাণের জন্য হয় তা সঠিক নয়। কারণ অনেক সময় সত্য না জেনে না বুঝে কখনও কখনও ভুল বুঝেও আন্দোলন হয়ে যায়।

তিতুমীর কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার আন্দোলনসহ বর্তমানের অনেক আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন। বাংলাদেশের মানুষ এমনিতে শান্তিপ্রিয় হলেও অনেকের বিবেচনা বোধে কিছু ঘাটতি আছে। সেই কারণে এই অঞ্চলের মানুষ খুব সহজে গুজবে বিশ্বাস করে। ওই গুজব যে কার্যকর তা আমরা বহুবার দেখেছি। ইংরেজদের বাংলার নবাবদের পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে প্রচারিত ধারাবাহিক গুজব এদেশের অনেক জনগণ বিশ্বাস করেছে। পাকিস্তান আমলে সামরিক সরকার প্রচারিত গুজবে ধর্মপ্রাণ মানুষরা পা দিয়ে অনেকেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও আমরা দেখেছি, বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের সময় গুজব কীভাবে আন্দোলনের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। সাম্প্রতিক জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত গুজব আন্দোলনের গতিপথ বদলানোর অপচেষ্টা হয়েছে।

তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উচিত যেকোনো আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে তাদের চিন্তা শক্তির প্রয়োগ সঠিক পন্থায় করা। তাদের ওই আন্দোলনের ফলে দেশ ও জাতির কতটা মঙ্গল হবে সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেওয়া, তারপর আন্দোলনে যুক্ত হওয়া জরুরি। সবার আগে সহিংসতা পরিহার করা দরকার। আর কখনও যদি আন্দোলন সহিংস হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওই আন্দোলন স্থগিত করাই শ্রেয়।

মহাত্মাগান্ধী এক্ষেত্রে তাদের পথ দেখাতে পারেন। মহাত্মাগান্ধী আন্দোলন সহিংস হলে তা স্থগিত করতেন বা পরিত্যাগ করতেন। তারা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারতেন। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন চলার সময়ে ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইউপি গ্রাম চৌরিচৌরার পুলিশ স্টেশনে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে।

ওই পুলিশ স্টেশনে রাজনৈতিক কর্মীদের তাড়া খেয়ে কিছু সংখ্যক পুলিশ আশ্রয়গ্রহণ করে। পুলিশের অত্যাচারে উত্তেজিত কতিপয় জনতা পুলিশ স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই ঘটনায় ২২ জন পুলিশ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনায় মহাত্মা গান্ধী বিচলিত হন। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের পরামর্শে মহাত্মা গান্ধী সন্ত্রাস ও সহিংসতা এড়াতে, মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে ১৯২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বারদৌলি গিয়ে তুঙ্গে চড়া অসহযোগ আন্দোলন সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করেন।

মনে রাখা দরকার, অহিংস আন্দোলনের চেয়ে শক্তিশালী আন্দোলন নেই। একটি প্রাণ না ঝরিয়ে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের বহু নজির বিশ্বের ইতিহাসে আছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অহিংস আন্দোলনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। জনবহুল এই দেশে সহিংসতায় মানুষ প্রাণ হারাবে এই বিষয়টি প্রায় স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে যেসব শিশু-নারী আহত হয়েছেন তাদের কাছে আমাদের সবার উচিত ক্ষমা চাওয়া। শুধু তিতুমীর কলেজ নয়, বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনের পাঠ নেওয়া উচিত।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version