-->

‘জেনোসাইড জো’ হয়ে অবসরে যাচ্ছেন বাইডেন

আলমগীর খান
‘জেনোসাইড জো’ হয়ে অবসরে যাচ্ছেন বাইডেন

সিনেট সদস্য ছিলেন ৩৬ বছর। এরপর বারাক ওবামার সঙ্গে দুবার ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। অবশেষে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিদায় নিতে যাচ্ছেন ‘জেনোসাইড জো’ অভিধা নিয়ে। বাইডেনের রাজনৈতিক জীবন যথেষ্ট বর্ণাঢ্য। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও কৃতিত্বপূর্ণ। কিন্তু শেষ ভালো যার সব ভালো তার- বাংলার এই প্রবাদ অনুযায়ী বাইডেনের শেষটা চরম রাজনৈতিক ব্যর্থতার। কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের হেরে যাওয়াই নয়, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যায় পূর্ণ সমর্থন ও বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়ায় মুখ্য ভূমিকা বাইডেনের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনকে কলঙ্কিত করেছে।

এর ফলে জো-বাইডেনের এক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন যা বিরাট ঔজ্জ্বল্য নিয়ে পরিণতি লাভের কথা তা সমাপ্ত হতে যাচ্ছে এক চরম ব্যর্থতা ও লজ্জা নিয়ে। ট্রাম্পকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ‘ফ্যাসিস্ট’ ভাবতে শুরু করেছিল এবং ২০২০ সালে ত্রাতা ভেবে ট্রাম্পের হাত থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ জো-বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে; তখন যারা তাকে ভোট দিয়ে এই কৃতিত্ব অর্জন সম্ভব করেছিল, এবার তাদের অনেকেই বাইডেনকে ত্যাগ করে উল্টো শিবিরে ভোট দিয়েছেন। কারণ কেউ তখন জানত না যে, অল্পদিনেই বাইডেন জেনোসাইড জো বা গণহত্যাকারী জো নামে পরিচিতি লাভ করবে। কমলা হ্যারিস যে ট্রাম্পের কাছে হারলেন তার মূল কারণ তার বাইডেনের পদাঙ্ক অনুসরণ। বাইডেন নিজে দাঁড়ালে হারতেন আরও বড় ব্যবধানে। বার্ধক্যজনিত অক্ষমতার কারণে ডেমোক্র্যাটরা তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরিয়ে দিলেও তার মূল অক্ষমতা ছিল ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণে। শুধু অক্ষমতাই নয়, ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি গণহত্যায় সরাসরি সহযোগিতা। জো-বাইডেন শেষ বিচারে এক যুদ্ধাপরাধী বলে পরিগণিত হয়েছেন। অবশেষে এই কুখ্যাতি নিয়েই তাকে রাজনীতি থেকে অবসর নিতে হবে।

ব্রিটেনের বিখ্যাত র‌্যাপ সংগীতশিল্পী করিম ডেনিস, যার মঞ্চ নাম লোকি, তিনি তার সাম্প্রতিক মিউজিক ভিডিও ‘জেনোসাইড জোতে গানে গানে এই কথাই বলেছেন। এই ভিডিওতে মায় খলিলের কণ্ঠে শোনা যায় : ‘জেনোসাইড জো, তুমি মানবাত্মাকে সন্ত্রস্ত করেছো, রাতে যখন চোখ বন্ধ করো, তুমি তখন ঘুমাও কি করে?’ আর লোকির কণ্ঠে শোনা যায় : ‘তুমি এক খুনি, তুমি এক সন্ত্রাসী, তুমি এক অপরাধী যার শয়তানি লক্ষ্য গণহত্যা।’ এই হচ্ছে বাইডেনের শেষ প্রাপ্তি। সমস্যাটা বাইডেনের একার নয় অবশ্য, তার দলের। ট্রাম্প যেদিন থেকে রাজনীতির মাঠে নেমেছেন, ডেমোক্র্যাটরাও সেদিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাসি রক্ষার মিশন নিয়ে কাছা দিয়ে নেমেছে। মানুষ সে কথায় আংশিক বিশ্বাস করে বাইডেন-কমলা জুটিকে ক্ষমতায় বসায়। এবার তারা ট্রাম্প কার্ড হিসেবে বেছে নেয় সেই পুরোনো গণতন্ত্র রক্ষার মহৎ কর্ম। কিন্তু মানুষ তাদেরকে নির্বাচন না করে বরং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি যে ট্রাম্প তাকেই জিতিয়ে দিয়েছে। মানে এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ আর গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না ও চায় না। আসলে গণতন্ত্রকে তারা ডেমোক্র্যাটদের কিংবা কমলা হ্যারিসের হাতে মোটেও নিরাপদ মনে করছে না।

কারণ গণতন্ত্র ও গণহত্যা একসঙ্গে যায় না। গণতন্ত্রের জন্য যাদের এত কান্নাকাটি তারা গাজায় ইসরায়েল পরিচালিত গণহত্যায় নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছে। গণতন্ত্র কতটুকু নিরাপদ হতে পারে তাদের হাতে যাদের কাছে ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই? সারা যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে তাকে নির্মমভাবে দমন করেছে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বাইডেন-কমলাই। এ প্রশ্নগুলোই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমান ভোটারদের। মিশিগানের মতো দোদুল্যমান রাজ্যগুলোয় মুসলমানরা এবার সংগঠিত হয়েছে গণহত্যার সহযোগী বাইডেন-কমলা চক্রের বিরুদ্ধে। একদিকে ডেমোক্র্যাটদের ওপর তাদের ছিল চরম ক্ষোভ, অন্যদিকে তারা যে ডেমোক্র্যাটদের পকেটের মুদ্রা না, তা এবার বুঝিয়ে দেওয়া।

ট্রাম্পের হাতে গণতন্ত্র যতই ঝুঁকিপূর্ণ হোক, ডেমোক্র্যাটরাও নিজেদেরকে গণতন্ত্রের রক্ষাকারী হিসেবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি এবং মানুষেরও বিশ্বাস অর্জন করেনি। তাদের নির্বাচনি কৌশলেও এর স্থান ছিল না। ব্রাঙ্কো মার্সেটিক এ ব্যাপারে জ্যাকোবিন সাময়িকীতে (ডেমোক্র্যাটস রেটোরিক অন ট্রাম্প অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি ওয়াজ অল রং, ১৮ নভেম্বর ২০২৪) লিখেছেন: স্পষ্টতই, অনেক আমেরিকানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র টিকে থাকার প্রশ্ন ট্রাম্প-প্রশ্নের চেয়ে গভীর। এটি পরিষ্কারভাবে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রশ্ন যেখানে অতি ধনী দাতারা নির্বাচনে নাক গলায় ও তাকে বিপথগামী করে, ওয়াল স্ট্রিট ও করপোরেট নেতৃত্ব উভয় দলের নীতিমালা নির্ধারণ করে, আর আইন প্রণেতাদের মনে সাধারণ নাগরিকদের অভাব ও প্রয়োজন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে। অন্য কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতি হুমকির ক্ষেত্রে অনেক আমেরিকানের দৃষ্টিভঙ্গিই বার্নি স্যান্ডার্স যা কয়েক বছর ধরে বলছেন তা থেকে ভিন্ন নয়, যখন কিনা তিনি হ্যারিসকে স্পষ্টভাবে বলতে অনুরোধ করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্রমে একটি সংখ্যালঘু ধনিক গোষ্ঠী শাসিত সমাজে পরিণত হতে যাচ্ছে।

দ্য হিলে (১২ সেপ্টেম্বর) আরও প্রকাশিত যে, স্যান্ডার্স নির্বাচনে হ্যারিসকে যে বার্তা প্রচারের পরামর্শ দেন তা হলো : প্রিয় আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষ, আমি তোমোদের পাশে, আমি কোটিপতি শ্রেণিকে দমন করবো, প্রচারাভিযানে চাঁদাদানকারী সম্পদওয়ালাদেরও ছাড়ব না যারা এই নির্বাচনকে বিভ্রান্ত করছে।

একই কথা বলেছেন প্রগতিশীল কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাশিয়ো-কোর্তেজ। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এবার পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন, কিন্তু কমলা এমন কিছুই বললেন না। জনগণ কমলার কাছ থেকে এমন কিছুই পাননি যা বাইডেন আমল থেকে ভিন্ন হবে এবং এটা তার পরাজয়ের একটি প্রধান কারণ। পরিবর্তনের ক্ষুধায় কাতর মানুষ সেদিকেই ঝুঁকেছে যেদিকে তারা ক্ষুধা নিবৃত্তির উপকরণ পেয়েছে, কমলা থেকে হতাশায় মুখ ফিরিয়ে গিয়েছে তাই ট্রাম্পের কাছে।

বাইডেন আমলের অর্থনেতিক সাফল্য সত্ত্বেও বড় ব্যর্থতা আন্তর্জাতিক পরিসরে যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটানোর মতো আশঙ্কাও তৈরি করেছে। রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে গণহত্যাসহ সারাবিশ্বের মানুষ এখন যুদ্ধের আতঙ্কের মধ্যে যার জন্য প্রধানত আমেরিকার বর্তমান প্রশাসনই দায়ী।

এখনও বাইডেন-কমলার সময় আছে তাদের ইতিহাসটা চুনকাম করে কিছুটা পরিচ্ছন্ন করার। ট্রাম্পের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই অর্থাৎ এখনই যদি তিনি গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধ করেন। এজন্য তাকে সর্বোচ্চ যা করতে হবে তা হচ্ছে এবারকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন যা বলেছিলেন তাই। অর্থাৎ ১৯৮২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান পশ্চিম বৈরুতে ইসরায়েলি হামলা বন্ধ করতে যে ছোট্ট কাজটি করেছিলেন, তেমন মাত্র— এখনকার নেতানিয়াহুকে কেবল একটা ফোন করে হামলা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া, কেননা এ হামলা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থে ও অস্ত্রে পরিচালিত। অবশ্য এ সুযোগ বাইডেনের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনই। শেষ পর্যন্ত লোকি ও মায় খলিলের গানের কথাই সত্য হয়ে টিকে থাকবে। বাইডেনের কথা আসলেই গাজার কথা মনে পড়বে। আর মনে পড়বে লোকির গানের কথা— ‘গাজা এক চিলতে ভূখণ্ড মাত্র নয়, বিশ্বের সর্বোচ্চ অপরাধ সংঘটনের দৃশ্যভূমি।’ কিংবা ‘এক নতুন পৃথিবী জন্মের জন্য লড়াই করছে। গাজার জ্বলন্ত অঙ্গার থেকে উড়বে পবিত্র ফিনিক্স পাখি।’ সেই নতুন পৃথিবীর ইতিহাসে এভাবেই স্মরিত হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ছেচল্লিশতম প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন। আমরা জানি না গাজায় গণহত্যা নিয়ে নিজ ডায়েরিতে কী লেখেন তিনি। তবে রাতে যখন চোখ বন্ধ করেন বাইডেন, তখন সত্যি তিনি ঘুমান কি করে?

লেখক: সমাজকর্মী।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version