-->

সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ জরুরি

আমীন আল রশীদ
সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ জরুরি

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে গত ২১ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি হলো। সেদিনই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। তাকে উদ্ধৃত করে ওই খবরে বলা হয়, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডসে মানবাধিকার সংগঠন ‘ভয়েস ফর বাংলাদেশ’ আয়োজিত সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

একটি গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যে ধরনের পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সরকারের প্রথম ১০০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও সেখানে অর্জন যে খুব বেশি নয়, সেটি সম্ভবত সরকার নিজেও স্বীকার করবে। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে জনমনে অসন্তোষ কমছে না। পোশাক খাতে অস্থিরতা এখনও আছে। আগের সরকারের আমলে সরকার-ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই, বেতন বন্ধসহ নানারকম অস্থিরতা চলছে। মব ভায়োলেন্স পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

সবশেষ ২৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের নরসিংহপুরে স্থানীয় মুসল্লি ও বিভিন্ন ইসলামী দলের বাধার মুখে ‘মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশ এখনও পুরোপুরি সক্রিয় নয় বলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে ভীতি কাজ করছে। মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ এখনও তীব্র। এসব কারণে অনেকেই মনে করছেন, দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিলে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অংশীদার শিক্ষার্থী, ছাত্র সমন্বয়ক, এমনকি সরকারে থাকা তাদের প্রতিনিধিরাও বলছেন যে শুধু নির্বাচনের জন্য জুলাই অভ্যুত্থানে শত শত মানুষ প্রাণ দেয়নি। তাছাড়া এই সরকার যেহেতু অতীতের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, অতএব, শুধু নির্বাচন করাই এই সরকারের একমাত্র কাজ নয়। বরং এই সরকারের প্রধান কাজ সংস্কার। অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে, সেগুলো দূর করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার লাগবে এবং তার জন্য সময় প্রয়োজন।

কিন্তু এই সংস্কারের জন্য ঠিক কতদিন লাগবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। নৌ উপদেষ্টার কথায় কিছুটা ইঙ্গিত মিললেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। আবার তিনি যে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচনের কথা বলছেন, সেটি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল মানবে কিনা এবং না মানলে এই ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের টানাপড়েন হবে কি না; সরকারের সঙ্গে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হবে কি না, অর্থাৎ দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে তারা মাঠে নামলে সরকার সেটি কীভাবে মোকাবিলা করবে এবং সেখানে সরকারের প্রধান অংশীদার শিক্ষার্থী, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং সরকার-ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে কি না, সেটিও বড় প্রশ্ন।

শুধু নির্বাচনের জন্য শত শত মানুষ প্রাণ দেয়নি, এটি যেমন সত্য, তেমনি যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটি এই অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারছে কিনা বা পারবে কিনা; সংস্কার করার মতো দক্ষ লোকবল সরকারে কতজন আছেন, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। গত সাড়ে তিন মাসে অন্তর্বর্তী সরকার কোন কোন খাতে সফল হয়েছে, সেই আত্মজিজ্ঞাসাটাও জরুরি।

সংস্কার কে না চায়?সংস্কারের অর্থ যদি হয় নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরা; সংস্কারের অর্থ যদি হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথ বন্ধ করা; সংস্কারের অর্থ যদি হয় নির্বাচনে জয়ের জন্য ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে তার একটি সীমারেখা ঠিক করে দেওয়া; সংস্কারের অর্থ যদি হয় রাজনীতির নামে পরিবারতন্ত্র ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ হওয়া; সংস্কারের অর্থ যদি হয় সরকার, দল ও রাষ্ট্র একাকার হয়ে না যাওয়া; সংস্কারের অর্থ যদি হয় একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান না হওয়া; সংস্কারের অর্থ যদি হয় সরকারি যেকোনো অফিসে যেকোনো কাজ বিনা হয়রানি ও বিনা ঘুষে সম্পন্ন হওয়া; সংস্কারের অর্থ যদি হয় উন্নয়নের নামে জনগণের অর্থের লোপাট বন্ধ হওয়া; সংস্কারের অর্থ যদি হয় বাজারে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সুযোগ বন্ধ করা এবং সবচেয়ে কম উপার্জনকারী ব্যক্তিটিও নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে মন খারাপ করবে না, তাহলে সেই সংস্কারের পক্ষে নিশ্চয়ই শতভাগ মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব সংস্কার কি একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে করা সম্ভব? আবার পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার যদি এই সংস্কারগুলো করতে না পারে, তাহলে নির্বাচিত সরকার এসেই এই সংস্কারগুলো করবে, তার নিশ্চয়তা কী? বা তারাও কি এই সংস্কারগুলো করতে পারবে?

সংস্কার কমিশন কী করবে?আগামী জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন সেই নির্বাচনটি কেমন হবে এবং কারা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। সম্ভবত তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, নতুন সরকার গঠনের পরে দেশ কি আগের মতোই দলীয়করণ, অনিয়ম, দুর্নীতি আর জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতির পথেই হাঁটবে, নাকি একটি নতুন ধরনের যে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলা হচ্ছে, সেই আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন হবে?

বস্তুত, এই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের সূত্রটা হতে পারে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে, যেটি নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।

গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পরে অন্তর্বর্তী সরকার ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এর বাইরে আছে একটি গুম কমিশন। যে ১০টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার অন্যতম নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এই কমিশনের প্রধান, যিনি নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করছেন। এই কমিশনে অন্যদের মধ্যে আছেন শাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ এবং নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা জেসমিন টুলি। এই কমিশনে একজন ছাত্র প্রতিনিধিও রয়েছেন।

এটা মানতেই হবে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট মূলত ঘুরপাক খায় নির্বাচন ইস্যুতে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নির্বাচনি ব্যবস্থাটা ধ্বংস করা হয়েছে, বলেই গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের পতন হলো। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পর পর তিনটি এবং সবশেষ চতুর্থ মেয়াদের সাত মাসে দেশের নানা ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেটি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরাও স্বীকার করবেন। কিন্তু ওই সরকারের সবচেয়ে বড় অপরাধ নিঃসন্দেহে নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে দেওয়া। আর এই ব্যবস্থাটি ধ্বংস করা হয়েছে সংবিধান ও আইনের মধ্যে থেকেই। সুতরাং, নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারই এখন প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত, যাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন না ওঠে, যাতে একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়। যাতে সরকার বা সরকারের অংশীদার কোনো পক্ষ নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।

এই লক্ষ্যে নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন কাজ করছে এবং এরই মধ্যে তারা বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়েছে। সবশেষ ২৩ নভেম্বর বেসরকারি টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশন, যেখানে সাংবাদিকরা রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি নির্বাচন দেওয়া, স্থানীয় সরকার নির্বাচন পুরোপুরি দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা, না ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া বন্ধ এবং জয়ের জন্য ন্যূনতম ভোট প্রাপ্তির বিধান যুক্ত করতে আইনি সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন। ২০২২ সালে প্রণীত সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনকে ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে পুরনো কাঠামো ও পদ্ধতিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনেরও সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ।

বস্তুত, প্রতিটি কমিশনই কিছু সুপারিশ সংবলিত একটি প্রতিবেদন সরকারকে দেবে। কিন্তু তারপর কী হবে? যদি নির্বাচনের পরে নতুন সরকার ওইসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে, তাহলে পুরোটাই পণ্ডশ্রম হবে। ফলে এখানে পরামর্শ হলো:১. কমিশনের প্রতিবেদনগুলো সরকারকে দেওয়ার পরে এগুলো ওয়েবসাইটে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কেউ যদি কোনো বিষয়ে মতামত দিতে চায়, সেই সুযোগ রাখতে হবে।২. কমিশনগুলোকে বুঝতে হবে যে রাতারাতি একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব নয়। অবাস্তব এবং খুব উচ্চাভিলাষী কোনো প্রস্তাব দিলে সেই সংস্কার প্রস্তাব কাগজেই পড়ে থাকবে, আলোর মুখ দেখবে না।৩. যে দশটি কমিশন গঠিত হয়েছে, তার মধ্যে তিনটি কমিশনের কাজের মধ্যে দারুণ সমন্বয় থাকা দরকার। এগুলো হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। কেননা, নির্বাচন কমিশন যে প্রস্তাব দেবে, সেখানে অনেক আইনি বিষয় যুক্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পরিবর্তন লাগবে। অতএব, সংবিধান সংস্কার কমিশনকে এগুলো জানতে হবে। আবার, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিষয়ে বাকি দুই কমিশনের মতামত জরুরি। অর্থাৎ, সবাই মিলে কাজটি না করলে এগুলো বিচ্ছিন্ন আকারে ইনডিভিজ্যুয়াল ডকুমেন্ট হয়ে থাকবে, যা আখেরে কোনো ভালো ফল দেবে না। বরং কিছু কিছু জায়গায় কনফ্লিক্ট তৈরি করবে।৪. প্রতিটি প্রতিবেদনে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলো নিয়ে সরকার ধারাবাহিকভাবে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পুনরায় সংলাপে বসতে পারে। কেননা, দিন শেষে এসব সুপারিশ তাদেরই বাস্তবায়ন করতে হবে।৫. নির্বাচনের আগে সব দলকে এসব সংস্কার প্রস্তাব তথা সুপারিশের ব্যাপারে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। ধারণা করা যায়, সংবিধান সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ করবে, তার অনেকগুলোর সঙ্গেই বিএনপিসহ আরও অনেক দল দ্বিমত করবে। আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সেই গ্যাপ বা শূন্যতা কমিয়ে আনতে হবে।৬. ভোটের আগে যদি রাজনৈতিক দলগুলো একটা লিখিত সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে যে, নির্বাচনে জয়ী হয়ে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, এই সংস্কারগুলো তারা বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ, সবাই একটা অভিন্ন অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করবে। আর এটি হবে এমন পদ্ধতিতে, যাতে এটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকে।

লেখক: সাংবাদিক।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version