বিশ্ব এইডস দিবস আজ ১ ডিসেম্বর। ১৯৮৮ সাল থেকে ১ ডিসেম্বর দিনটি এইডস দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিউএইচও) এইডস সম্পর্কিত বিশ্ব কর্মসূচির দুইজন জনতথ্য কর্মকর্তা জেমস ডব্লুবুন এবং টমাস নেটটার ১৯৮৭ সালের আগস্ট মাসে প্রথম বিশ্ব এইডস দিবসের পরিকল্পনাটি এইডস সম্পর্কিত বিশ্ব কর্মসূচির (বর্তমানে আনএইডস নামে পরিচিত) পরিচালক ড. জোনাথন মানের কাছে জানিয়েছিলেন। তিনি এই ধারণাটি পছন্দ করেন এবং ১৯৮৮ সালের ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবসটি পালন করার জন্য অনুমোদন দেন।
সান ফ্রান্সিসকোর সাবেক টেলিভিশন সম্প্রচার সাংবাদিক বুন, ১ ডিসেম্বর তারিখটির সুপারিশ করেছিলেন। কারণ এ দিন সংবাদমাধ্যমগুলো দ্বারা বিশ্ব এইডস দিবসের প্রচার সর্বাধিক হবে বলে মনে করেছিলেন। তাই এ দিনটিই বিশ্ব এইডস দিবস হিসেবে এইডস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং যারা মারা গিয়েছেন তাদের প্রতি শোকপ্রকাশ করতে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব এইডস দিবসে এইডস সম্পর্কে সচেতনেতা বৃদ্ধিই হবে এর মূল প্রতিরোধ।
এইডস একটি সংক্রামক ব্যাধি। বর্তমানে এইডসকে মহামারি হিসেবে গণ্য করা হয়; কারণ এটি বিশ্ব জনসংখ্যার বিশাল আয়তন জুড়ে বিস্তৃত এবং সক্রিয় ভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। প্রতি বছর এই মরণব্যাধি সংক্রামক রোগের সংখ্যা বাংলাদেশেসহ পৃথিবীর অনেক দেশে বেড়েই যাচ্ছে। সময়মতো ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেকেই অল্প সময়ে প্রাণ হারাচ্ছেন এই সংক্রমক ব্যাধির আক্রমণে। অনিরাপদ যৌন মিলন ও একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহারই এই এইডস ছড়ানোর মূল কারণ। আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি-ই হতে পারে এইডসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রধান ধাপ। আর এইডস সম্পর্কে সচেতন হতে হলে আমাদের সকলের এইডস সম্পর্কে সঠিক ধারনা ও সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে। চলুন এ বিষয়ে জেনে নিই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
এইডস ও এইচআইভি কি: এইচআইভি (হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) হলো রেট্রো শ্রেণীর একটি ভাইরাস। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, এই এইচআইভি ভাইরাসটি সর্বপ্রথম ১৯৩০ দশকের শিম্পান্জিদের মধ্যে বিদ্যমান একটি ভাইরাস থেকে এসেছে। যা মূলত শিকারের সময় মানব রক্তে স্থানান্তরের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এইডস (একুয়্যাইর্ড ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) হলো এইচআইভি ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট একটি রোগের লক্ষণ সমষ্টি; যা মানুষের দেহে রোগ-প্রতিরোধের ক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কমিয়ে দেয়। যার ফলে এই রোগে আক্রান্ত রোগী খুব সহজেই অন্যান্যা সংক্রামক রোগে (যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জা, মেনিনজাইটিস, ক্যানসার ইত্যাদি) আক্রান্ত হতে পারে এমনকি মৃত্যু হতে পারে। এই ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করলেই এইডস হয় না। বরং ১০-১৫ বছর লাগে এইডস দেখা দিতে পারে সংক্রমিত ব্যক্তির দেহে। অর্থাৎ যে ব্যক্তির দেহে এই ভাইরাস আছে, তাদের বেশিরভাগই কোন রোগের প্রকাশ করে না। আর এ কারণে অনেকেই সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে পারে না। এতে আক্রমনের পর যখন একজন ব্যক্তির মাঝে কিছু লক্ষণ যেমন জ্বর, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, টিউবারকুলোসিস (টিবি) ইত্যাদি দেখা দেয়, তখনি সে ব্যক্তির এইডস হয়েছে বলা যেতে পারে।
এইডস কিভাবে হয়?মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী কিছু কোষ আছে। এইচআইভি ভাইরাসটি প্রধানত মানবদেহের এ সকল কোষ যেমন হেল্পার টি কোষ, ম্যক্রোফেজ কোষ ও ডেনডাইট্রিক নামক কোষগুলোকে আক্রমণ করে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ সকল কোষের সংখ্যা কমিয়ে দেয়। আর এসব কোষের মধ্যে কিছু কোষ আছে সাইটোটক্সিক ৪+(সিডি৪+) যা প্রধানত সংক্রমিত কোষকে চিনতে পারে, সে সকল কোষ হ্রাস পেতে থাকে এবং এদের পরিমাণ নির্দিষ্ট একটি পর্যায়ে নেমে আসে, তখন-ই মানবদেহের সেল মেডিয়েটেড ইমিউনিটি নষ্ট হয়ে যায় এবং দেহ অপরচুনেস্টিক ইনফেকশনের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে; যার ফলে সহজেই বিভিন্ন রোগ সংক্রমিত হতে পারে।
কাদের বেশি হয়?: বিশ্বব্যাপী এইচআইভি আক্রান্তদের অর্ধেকেরও বেশি নারী। অল্প বয়সী মহিলাদের (১৫-২৪ বছর বয়স) একই বয়সী যুবকদের তুলনায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দ্বিগুণ বেশি। যৌনকর্মী এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকসেবীদের মাঝে এইডসের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত নারী বা পুরুষের সাথে কনডম ব্যবহার না করে যৌন সম্পর্কে স্থাপন করার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন। অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত নিলে, এরকম কারও ব্যবহৃত একই সিরিঞ্জ শরীরে প্রবেশ করলেও আপনি এই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হন। এছাড়া এইচআইভি পজিটিভ গর্ভবতী মায়ের থেকে সন্তানের দেহেও সংক্রমণ হতে পারে; তখন তা খুবই কম ক্ষেত্রে হয়।
প্রথম এইডস কোথায় শনাক্ত হয়: বিশ্বব্যাপী এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা গেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৯৮১ সালে সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এইডস রোগী শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৮৯ সালে এইডস আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে। বাংলাদেশে এইডস সংক্রমিত মানুষের অনুমিত সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৮ হাজার ৩২ জন। আর এই রোগে মারা গেছেন এক হাজার ৩৮৩ জন। দেশে এইডস সংক্রমণের হার শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
এইডসের প্রতিকার ও প্রতিরোধ কিভাবে সম্ভব: অনেকেরই ধারণা যে, এইডসে আক্রান্ত রোগীদের সাথে কোলাকুলি, হ্যান্ডশেক করলে বা একই সাথে খাওয়াদাওয়া করলে অথবা একই থালা বাসন ও গ্লাস ব্যবহার করলেও এইডস হয়; কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এরকম মেলামেশায় এমনকি এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চুমু দিলে বা জরিয়ে ধরলেও এইডস হয় না। সমাজে এইডস আক্রান্ত রোগীদেরকে অনেকেই আলাদা করে দেয়, তাদেরকে হেয় করা থেকে শুরু করে এবং তাদের সাথে দুরত্ব তৈরি করে।
অবৈধ যৌনাচারের বাইরেও এটি হতে পারে। তাই এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদেয় হেয় করা ঠিক নয়। এইচআইভি রোগীরাও মানুষ। তাদের ও মানবাধিকার রয়েছে। অন্য দশটি রোগের মতোই এটি একটি রোগ। বর্তমানে এরও চিকিৎসা রয়েছে। হয়তো চিকিৎসা দিয়ে একেবারে নিরাময় করে ফেলা সম্ভব নয়। তবে অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত লক্ষণহীন রাখা সম্ভব এবং আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে রাখা সম্ভব। বেশির ভাগ এইডসে আক্রান্ত রোগী এইডসকে ভয় পায় এবং সেজন্য তারা তাদের রোগের কথা নিয়ে আলোচনা করতে চায় না এবং হীনমন্যতায় ভোগে। ফলে তাদের মাঝে এইডসের প্রভাব আরও বাজেভাবে বেড়ে উঠে। তাই এইডস আক্রান্ত রোগীদেরকে দূরে না সরিয়ে তাদের সাথে সহমর্মি হয়ে তাদের সাহায্য করা ও তাদেরকে সাহস দেওয়া প্রয়োজন যেন তাদের মাঝে আত্মশক্তি বেড়ে উঠে এবং তদের মাঝে এইডস সম্পর্কিত ভয় দূর হয়।
আমাদের মাঝে শুধু মাত্র অজ্ঞতার কারণেই এইডস ছড়াচ্ছে। অনেকেই এইডস সম্পর্কে জানতে পারছে না কারণ এ দেশের অনেক বড় একটি অংশের মানুষ নিরক্ষর। ফলে আমাদের বেশির ভাগ জনসংখ্যার মাঝে এইডস এর সঠিক ধারনা পৌছাচ্ছে না। আর এজন্যই মূলত প্রতিবছর এই দিনটিতে বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয় যাতে জনসচেতনতা বাড়ানো যায়।
এইচআইভি প্রতিরোধের মূল উপায় হলো শিক্ষা, সচেতনতা ও মানুষের চিন্তায় ও আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন। যে দিকগুলো অবশ্যই অনুশীলন করতে হবে তা হলো, নিরাপদ যৌন অভ্যাস তৈরি করা, একাধিক যৌনসঙ্গী পরিহার ও অপরিচিত কারো সাথে এবং অবৈধ যৌন ক্রিয়া থেকে বিরত থাকা। ধর্মীয় অনুশাসনে দাম্পত্য জীবনযাপন করা। রক্ত ও যেকোন অঙ্গ আদান প্রদানের সময় অবশ্যই সঠিক পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে এইডসের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।
একই সুচ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার না করা, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহন না করা ও মাদকসেবনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রনয়ণ ও কার্যকর করতে হবে। এছাড়া তরুণ সমাজের পাশাপাশি সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে এইডস সম্পর্কে প্রচার ও প্রসারে। কারণ বাঁচতে হলে জানতে হবে।
লেখক: চিকিৎসক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য