-->

স্বার্থবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

আ. কা. ফজলুল হক
স্বার্থবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

নীতি ও আইনের পেছনে একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল থাকে একদিকে মানুষের আবেগ ও স্বার্থবুদ্ধি, অপরদিকে মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনা। মানুষমাত্রই আবেগ ও স্বার্থবুদ্ধি এবং মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনার অধিকারী। এসব মানুষের চেতনার অন্তর্গত। কায়েমি-স্বার্থবাদীদের রাজনীতির বাইরে জনগণের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হলে মানুষের নৈতিক সত্তাকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। কায়েমি স্বার্থবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাজ্য।

নৈতিক চেতনার স্বরূপ বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে চেতনার স্বরূপ। চেতনা কী? চেতনা হলো অত্যুন্নত বস্তুর আপন সত্তায় বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎকে অনুভব করার এবং কোনো কিছুর স্পর্শে বা প্রভাবে সাড়া দেওয়ার শক্তি। প্রাণীর জীবন্ত দেহ হলো অত্যুন্নত বস্তু, তার মধ্যে পরিবেশের স্পর্শে বা প্রভাবে অস্তিমান হয় চেতনা। পরিবেশের স্পর্শ বা প্রভাব ছাড়া মানবদেহে বা অন্য কোনো প্রাণীর দেহে চেতনা দেখা দেয় না। মানুষের চেতনার মধ্যে তার আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি, বিচারশক্তি ইত্যাদি থাকে। মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনা মানুষের সমগ্র চেতনারই অংশ। চেতনার মধ্য দিয়েই জীবনের পরিচয়। জীবনের রহস্য অন্তহীন। মানুষের চেতনার রহস্যও অন্তহীন।

চেতনা বস্তুকে অবলম্বন করে অস্তিত্ব লাভ করে ও অস্তিমান থাকে। বস্তুর অবলম্বন ছাড়া কোথাও কোনো প্রকার চেতনার সন্ধান পাওয়া যায় না। চেতনার এই বস্তুগত অবলম্বন দ্বিকেন্দ্রিক:

এক. একদিক থেকে দেখা যায় প্রাণীর দেহকে- তার ইন্দ্রিয়, স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ককে অবলম্বন করে চেতনা অভিব্যক্তি লাভ করে ও বিকাশমান থাকে। জীবন্ত প্রাণিদেহের বাইরে- জীবন্ত প্রাণীর ইন্দ্রিয়, স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের প্রত্যক্ষ অবলম্বন ছাড়া কোথাও কোনো চেতনার অস্তিত্ব নেই। মৃত মানুষের কিংবা মৃত প্রাণীর মধ্যে কোনো চেতনা দেখা দেয় না। প্রাণীর দেহ, মানুষের দেহ- ইন্দ্রীয়, স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ক সবই বস্তু দিয়ে গড়া। জৈব বস্তু এবং প্রাণবান বস্তুর রহস্য উদঘাটনে প্রাণিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, প্রাণরসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান কিছুদূর এগিয়েছে এবং আরও এগোচ্ছে। মানুষের অনুভূতি, উপলব্ধি, চিন্তা, আবেগ, লোভ, ভয়- এসবের কোনটির জন্য মানুষের মস্তিষ্কের কোনো অংশ কীভাবে সক্রিয় হয়, সে সম্পর্কে পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানযান্ত্রিক পরীক্ষার সাহায্যে খুব সুনির্দিষ্টভাবে কিছু তথ্য এখন জানাতে পারে; আশা করা যায় ভবিষ্যতে আরও পারবে। যে কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে তা হলো, দেহের অবলম্বন ছাড়া, বস্তুর অবলম্বন ছাড়া শূন্যের মধ্যে কোনো প্রকার চেতনা নেই। চেতনার এই বৈশিষ্ট্যের কথা ভুলে গেলে চেতনা সম্পর্কে, মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনা সম্পর্কে, জীবন ও আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত ভুল হতে বাধ্য।

দুই. অন্যদিক থেকে দেখা যায়, চেতনার স্নায়ুগত অবলম্বনের মতোই আছে তার পরিবেশগত অবলম্বন। পরিবেশের স্পর্শে বা প্রভাবেই জীবন্ত প্রাণীর ইন্দ্রিয়, স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ক সক্রিয় হয় এবং চেতনা দেখা দেয়। পরিবেশের স্পর্শ বা প্রভাব ছাড়া কেবল ইন্দ্রিয়, স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কে কোনো চেতনা দেখা দেয় না। বাহ্যবস্তুর স্পর্শ বা প্রভাব ছাড়া ইন্দ্রিয়, স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের কোনো সক্রিয়তা নেই। চেতনার পরিবেশ-নিরপেক্ষ কোনো অস্তিত্ব নেই। মনে রাখতে হবে, ইন্দ্রিয়, স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ক ব্যতিরেকে যেমন চেতনা, বোধ, অনুভূতি-উপলব্ধি, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও বিচারশক্তি নেই; তেমনি পরিস্থিতি, পরিবেষ্টন বা পরিবেশের অবলম্বন ছাড়াও এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই।

চেতনার একদিকে আছে জীবিত প্রাণীর জৈব ভিত্তি তথা অন্তর্জগৎ এবং অপরদিকে আছে পরিবেশগত ভিত্তি বা বহির্জগৎ। একদিকে অহং, অপরদিকে ইদং। একই সঙ্গে এই দুই ভিত্তি ছাড়া কোথাও কোনো চেতনার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। চেতনার মূলে একই সঙ্গে থাকে জীবন্ত প্রাণীর অন্তর্গত জৈব ভিত্তি এবং বহির্গত বা পরিবেশগত ভিত্তি।

ব্যক্তিজীবনের ও জাতীয় জীবনের সমস্যাবলি সমাধানের জন্য ব্যক্তির ও জাতির জীবনের জৈব ভিত্তি ও পরিবেশগত ভিত্তি- দুটোকেই একসঙ্গে বিবেচনায় ধরতে হবে। বাংলাদেশে প্রগতিপ্রয়াসীদের মধ্যে এই জটিল বিষয়টির উপলব্ধি দরকার। কেবল একদিক বিবেচনায় নিলে সিদ্ধান্ত ভুল হয় এবং প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কায়েমি-স্বার্থবাদীরা এবং সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।

মানুষের চেতনার মর্মে আছে আবেগ ও স্বার্থবুদ্ধি এবং মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনা। আবেগ হলো কোনো কিছু করার তীব্র ইচ্ছা। নানা বাহ্য কারণে আবেগ দেখা দেয়। স্বার্থ হলো নিজের প্রয়োজন মেটানো এবং কামনা-বাসনা ও আশা-আকাক্সক্ষার পরিতৃপ্তি সাধন। মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিত ও সমৃদ্ধ করতে চায়, কামনা-বাসনা ও আশা-আকাক্সক্ষা চরিতার্থ করতে চায়। মানুষ আত্মরক্ষা, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রসার চায়। মানুষ ভোগবিলাস চায়, ক্ষমতা চায়, খ্যাতি চায়। এরই মধ্যে তার স্বার্থবুদ্ধির পরিচয়। মানুষ কীভাবে তার স্বার্থ কতটা চরিতার্থ করবে, তার সঙ্গে যুক্ত থাকে তার মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনা ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে এবং স্বার্থবুদ্ধি ও আবেগ ক্রমেই প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। মানুষ চলছে মূলত সুবিধাবাদ অবলম্বন করে।

মূল্যবোধ হলো মূল্যের বোধ অর্থাৎ কোনটি মূল্যবান, কোনটি মূল্যহীন, কোনটি বেশি মূল্যবান, কোনটি কম মূল্যবান, কোনটি কল্যাণকর, কোনটি অকল্যাণকর, কোনটি লাভজনক, কোনটি ক্ষতিকর- এ সম্পর্কিত বোধ। মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব সেজন্য স্বার্থের বেলায় সে কেবল নিজের স্বার্থ ভেবে চলতে পারে না; নিজের স্বার্থের সঙ্গে সমাজের অন্যদের স্বার্থের কথাও তাকে ভাবতে হয়। নিজের নিরাপত্তা ও সাফল্যের প্রয়োজনেই অন্যদের ভালো-মন্দও বিচার করতে হয়। অসংযত হলে ক্ষতি হয়। এই বিচারের বোধই মূল্যবোধ। সুস্থ স্বাভাবিক নর-নারী মাত্রেরই চেতনায় দেখা যায় মূল্যবোধ। সম্মিলিত জীবনে মূল্যবোধের কার্যকারিতার জন্য দরকার হয় নীতি ও আইন।

কায়েমি স্বার্থবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের নীতি ও কার্যক্রম থেকে জনসাধারণের নীতি ও কার্যক্রমকে আলাদা করতে হবে। জনসাধারণের রাজনীতি ও আদর্শকে কায়েমি স্বার্থবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের রাজনীতি ও আদর্শ থেকে ভিন্নরূপ দিতে হবে। সর্বজনীন কল্যাণের নীতি নিয়ে গঠন করতে হবে আলাদা দল। জনগণের রাজনৈতিক দলের অন্যতম কর্মনীতি হবে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা। প্রতিক্রিয়াশীলদের মোকাবিলার পাশাপাশি আত্মগঠন, আত্মসমালোচনা ও আত্মোৎকর্ষের কার্যক্রম চালাতে হবে। নীতি থেকে এসেছে নৈতিক। নীতি হলো সাধনপ্রণালি। কোনো কিছু করতে হলে, কোনো কিছুতে সফল হতে হলে স্বতঃস্ফূর্ততার পথ ধরে তা সম্ভব হয় না। সাফল্যের জন্য মানুষকে সুনির্দিষ্টভাবে উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে হয়, উদ্দেশ্য সফল করার জন্য প্রকৃতির নিয়ম জেনে নিজের চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাস্তবসম্মত কর্মনীতি অবলম্বন করে উদ্দেশ্য সফল করতে হয়। বৃহৎ ও জটিল কিছু করতে হলে অনেক জটিলতা অতিক্রম করতে হয়। নীতিবিদ্যায় এসব বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণ আছে। তবে একাডেমিক নীতিবিদ্যা এমন এক অন্ধকার ঘরে কালো বিড়াল খোঁজার মতো ব্যাপার, যে ঘরে সেই বিড়াল নেই। আসলে নৈতিক সমস্যার সমাধান কেবল অধ্যয়ন অনুসন্ধান দিয়ে হয় না, তার জন্য অধ্যয়ন অনুসন্ধানের সঙ্গে কাজে যেতে হয়। চিন্তা ও কাজ দুটোই দরকার হয়।

মানুষের জীবনযাত্রার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার কোনোটিই প্রকৃতিতে তৈরি অবস্থায় থাকে না, মানুষকে তার ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস তৈরি করে নিতে হয়। মানুষ উৎপাদনশীল ও সৃষ্টিশীল প্রাণী। মানুষ ফসল উৎপাদন করে, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প সৃষ্টি করে।

রাষ্ট্রে ও সমাজে আইন হলো নীতির উচ্চতর রূপ। আইন প্রণয়ন করার, কার্যকর করার প্রয়োজনে শক্তিপ্রয়োগে কার্যকর করার বৈধ ক্ষমতা থাকে সরকারের। আইন ও নীতির মর্মে কাজ করে মানুষের মূল্যবোধ কায়েমি-স্বার্থবোধ কিংবা সর্বজনীন কল্যাণবোধ। নৈতিক চেতনা হলো মানুষের চেতনার সেই অংশ যা মানুষকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সুন্দর-কুৎসিত, উচিত-অনুচিত, কর্তব্য-অকর্তব্য, মঙ্গল-অমঙ্গল ইত্যাদি বিচার করতে এবং ভালো, ন্যায়, সুন্দর, কল্যাণ, উচিত ও কর্তব্যের পক্ষ অবলম্বন করে কাজ করতে চালিত করে। নৈতিক চেতনারও একদিকে আছে মানুষের অন্তর্গত জৈব ভিত্তি-অন্তর্জগৎ, অপরদিকে আছে বহির্জগৎ বা পারিপার্শ্বিক ভিত্তি, পরিস্থিতি, পরিবেষ্টন, পরিবেশ এক কথায় বহির্জগৎ।

নীতি, আইন প্রণয়নে সাম্রাজ্যবাদী ও কায়েমি-স্বার্থবাদীদের চিন্তা ও ধারা থেকে সর্বজনীন কল্যাণের চিন্তা ও কর্মধারাকে স্বতন্ত্র ধারায় বিকশিত করতে হয়। এই স্বাতন্ত্র্যের অভাব ঘটলে সর্বজনীন কল্যাণ ব্যাহত হয়। জনগণের রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব না থাকলে জনগণ বঞ্চিত ও প্রতারিত হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধ, নৈতিক চেতনা ও নৈতিক সমস্যার স্বরূপ বুঝতে হলে দর্শনে মানুষের স্বরূপ নামে যে সমস্যাটি আলোচিত হয়, সে সম্পর্কে গভীর জ্ঞান দরকার। মানুষকে বুঝতে হবে তার অন্তর্জীবনের দিক দিয়ে, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক দিয়ে, ইতিহাসের দিক দিয়ে এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিক দিয়ে। নৈতিক উন্নতির জন্য পারিপার্শ্বিক নানা বিষয়ের জ্ঞানের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের ও ইতিহাসের জ্ঞানও অপরিহার্য।

ইতিহাসে দেখা যায়, স্বার্থের সংঘাত, নৈতিক সমস্যা ও আইনের শাসনের সমস্যা কেবল মনোজগতের দিকে কিংবা কেবল পরিবেশের দিকে তাকিয়ে সমাধান করতে চাইলে করা যায় না; সমাধান করতে হলে একসঙ্গে মনোজগৎ ও পরিবেশ দুই দিকেই তাকাতে হয় এবং মনোজগতের পরিবর্তনকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য পরিবেশগত ভিত্তি বদলাতে হয়। কেবল চিন্তা দিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান হয় না, সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ লাগে চিন্তা ও কাজ দুই লাগে। প্রগতির পথে চলতে হলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে মোকাবিলা করে চলতে হয়।

লেখক: আবুল কাসেম ফজলুল হক, চিন্তাবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

Beta version