বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো (পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ) দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তবে, এ সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা অনেকাংশেই কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল; যা তাদের স্বনির্ভরতা এবং কার্যক্ষমতাকে সীমিত করে। আর্থিক স্বাধীনতা বা স্বনির্ভরতা অর্জন ছাড়া স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো তৃণমূল পর্যায়ে প্রকৃত উন্নয়ন আনতে পারে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর আর্থিক স্বনির্ভরতার মাধ্যমে উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে এ সংস্থাগুলোর জন্য উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
সর্বাগ্রে কর আরোপের ক্ষমতা ও রাজস্ব সংগ্রহ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস হলো কর আদায়। তবে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের কর আদায়ের ক্ষমতা সীমিত; যা তাদের আয়ের পরিমাণকে সরাসরি প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের স্থানীয় সরকারগুলোকে (যেমন পঞ্চায়েত ও মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন) বাড়ি, যানবাহন, ব্যবসা এবং বিভিন্ন খাতের ওপর সরাসরি কর আরোপের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই রাজস্ব উৎসগুলো তাদের স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে আরও বেশি কর আরোপের ক্ষমতা দিতে হবে। শুধুমাত্র বাড়ি বা ব্যবসা কর নয়, পরিবেশ সংরক্ষণে ‘গ্রিন ট্যাক্স’ এবং পর্যটন এলাকায় পর্যটন কর আরোপ করা যেতে পারে। এ ধরনের কর ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পাশাপাশি জনগণকে বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে গৃহকর বা প্রোপার্টি ট্যাক্সের ডিজিটালাইজেশন করতে হবে; যাতে কর আদায় প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ হয়। স্থানীয় সরকারের আর্থিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির আরেকটি উদ্ভাবনী উপায় হলো পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলের বাস্তবায়ন। বিশ্বজুড়ে সফলভাবে PPP মডেল ব্যবহার করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক স্থানীয় সরকার সংস্থা তাদের অবকাঠামোগত প্রকল্প, যেমন সড়ক উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পানি সরবরাহের জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোতে PPP মডেলকে উৎসাহিত করতে হবে। সড়ক উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পানির সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে অর্থায়ন এবং বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ দেখা যায়।
তবে স্থানীয় পর্যায়ে এই মডেলের পরিসর আরও বাড়িয়ে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি, বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য মিউনিসিপাল বন্ড ইস্যু করতে পারে। এ উদ্যোগ জনগণকে আর্থিক বিনিয়োগে সম্পৃক্ত করবে এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করবে। বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সরকার ও উন্নয়ন কার্যক্রমের সরাসরি সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। যেমন, বড় প্রকল্পগুলোতে এই তহবিল ব্যবহার করে স্থানীয় সড়ক, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও পানি ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করা যেতে পারে।
উদাহরণসরূপ, ব্রাজিল ও মেক্সিকোর স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো মিউনিসিপাল বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। মিউনিসিপাল বন্ড ইস্যু করে তারা নগর উন্নয়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে থাকে; যা সরাসরি জনগণের বিনিয়োগ উৎসাহিত করে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনে। সম্পদ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি করা দরকার। সিঙ্গাপুর তার সরকারি জমি এবং সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে অনুকরণীয় উদাহরণ তৈরি করেছে। সিঙ্গাপুরের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো বাণিজ্যিক সম্পত্তি এবং আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে বড় পরিমাণ আয় সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর অধীনে থাকা জমি ও সরকারি সম্পত্তি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। খাস জমি বা অন্যান্য সরকারি সম্পত্তি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করলে তা থেকে উল্লেখযোগ্য আয় উৎপাদন সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় সরকারগুলোকে শহরাঞ্চলে বাজার, বাস টার্মিনাল, পার্কিং জোন এবং খুচরা দোকান ইজারা দিতে পারে; যা তাদের জন্য স্থায়ী আয়ের উৎস হয়ে উঠবে।
পাশাপাশি, ডিজিটাল ট্যাক্সেশন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থা চালু করে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে কর ফাঁকি রোধ হবে এবং জনগণ অনলাইনে কর প্রদান করতে সক্ষম হবে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার বিভিন্ন পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনগুলোতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর আদায়ের প্রক্রিয়া চালু করা হলে প্রশাসনিক কার্যক্রম দ্রুততর এবং দুর্নীতিমুক্ত হবে। এ ক্ষেত্রে এস্তোনিয়ার মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। এস্তোনিয়া ডিজিটালাইজেশন এবং ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে; যা স্থানীয় সরকারগুলোর কার্যকারিতা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। তাদের ই-ট্যাক্স ব্যবস্থা কর আদায়কে সহজ এবং স্বচ্ছ করেছে, এবং জনগণের জন্য সেবা প্রদানে গতিশীলতা এনেছে।
এছাড়া স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর আর্থিক স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করার জন্য দক্ষ বাজেট ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ ব্যয় করা হয় বা সঠিক বাজেট পরিকল্পনার অভাবে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সময়মতো সম্পন্ন হয় না। বাজেট ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে প্রশিক্ষিত আর্থিক পরিকল্পনাকারী এবং নিরীক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় সংস্থাগুলোকে আর্থিক পরিচালনার জন্য সক্ষম করতে প্রশিক্ষণ এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ উন্নত ফান্ড ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে বাজেটের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক সময়নিষ্ঠা বজায় রাখা সম্ভব।
অধিকন্তু অর্থায়নে সুশাসন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর মধ্যে অর্থ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ অর্থ অনেক সময় সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় না বা অনিয়মের কারণে তহবিল অপচয় হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং অর্থ ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিরপেক্ষ নিরীক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন। স্থানীয় স্তরে প্রশাসনিক তদারকি এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সংস্থাগুলোকে সঠিকভাবে তাদের তহবিল ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হলে আর্থিক ব্যবস্থাপনা আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর হবে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে আরও স্বাধীনতা দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। রাজস্ব সংগ্রহ, প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং স্থানীয় বাজেট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও ক্ষমতা স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর হাতে তুলে দিতে হবে। এই ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে; যা উন্নয়ন কার্যক্রমে গতিশীলতা আনবে।
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর আর্থিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে একাধিক উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। কর আরোপের ক্ষমতা বৃদ্ধি, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, মিউনিসিপাল বন্ড ইস্যু, ডিজিটাল ট্যাক্সেশন এবং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করা সম্ভব। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারগুলো আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করে উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে পারবে; যা সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: লোক প্রশাসন এবং জননীতি গবেষক
মন্তব্য